থেকে থেকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। যতক্ষণ ঘুমাই, দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই দেখিনা। সারাদিন অস্থিরতার মধ্যে থাকি। কোনো কাজে মন বসে না। আবার বসেও থাকা যায় না। সব মিলিয়ে বিশ্রী-ঘোলাটে একটা অবস্থা। এই অবস্থা আমার একার নয়। যাদের সাথেই আমার কথা হয়, সবারই একই পরিস্থিতি। কেউই ভাল নেই। থাকবেই বা কিভাবে? গোটা দেশটাই একটা রক্তস্নাত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কি সাধারন একটা আন্দোলন করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। একটাই দাবি – কোটা পদ্ধতির সংস্কার চায়। কিন্তু তা আর হতে দিল কই? ছাত্রছাত্রীদের হেয় করে প্রধানমন্ত্রী সহ অনেক মন্ত্রীদের লাগামহীন মুখের বুলি পরিস্থিতি উথাল করে তুলে। সরকার প্রথমে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে, পরে পুলিশ দিয়ে, এবং শেষ পর্যন্ত না পেরে বিজিবি-আর্মি নামিয়ে আন্দোলন ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা এখনও করে চলছে।
‘দেখামাত্র গুলি’ করার এই বর্বরতা থেকে ছোট-বড়, ছাত্র-অছাত্র কেউ রেহাই পায়নি। হোক সেটা অসীম সাহসিকতায় অস্ত্রের মুখে বুক পেতে শহীদ হওয়া আবু সাঈদ, অথবা বাবার সাথে বিকালে খেলতে গিয়ে গুলি খাওয়া ছোট্ট শিশু রিয়া বা যৌক্তিক আন্দোলনে বন্ধুদের পানি বিলিয়ে বেড়ানো মুগ্ধ – সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশের প্রতিটা ঘরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শুধুমাত্র ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলন থেকে এই আন্দোলন জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করেন বাবামা, শিক্ষকশিক্ষিকা থেকে শ্রমজীবীরা পর্যন্ত। সরকার ভেবেছিল গুলি করলে ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে পালাবে। তারা জানত না, এক আবু সাঈদকে মারলে হাজারো আবু সাঈদ বন্দুকের মুখে বুক পেতে হাসতে হাসতে প্রাণ দিবে। তারা জানতো না, এক মুগ্ধকে মারলে হাজার মুগ্ধ এসে পানি বিলিয়ে যাবে। তারা জানত না রক্ত সাহসকে হাজারগুনে বাড়িয়ে তুলবে। বহু নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করেও সুবিধা করতে পারেনি সরকার। ঠিক যেন একাত্তরের মত বিদেশি মিডিয়ার কল্যাণে এই নৈরাজ্যের খবর দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়ার নানান প্রান্তে থাকা বাঙ্গালি ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ গড়ে তুলে। অবশেষে সরকার হাইকোর্টের আপিল বিভাগের রায় এগিয়ে এনে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে। কিন্তু ততদিনে অনেক পানি গড়িয়েছে। সারাদেশে বয়ে গেছে রক্ত গঙ্গা। এটা আর কোটা সংস্কার আন্দোলন নেই। হয়ে গেছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এর মধ্যে সরকারী পোষা বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষরিত বিবৃতি দিয়ে বা গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, বা জামাত-শিবির-বিএনপির উপর দায় চাপিয়ে আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা সেটা হতে দেয়নি। তারা সফল। এখনও আন্দোলন চলছে সারাদেশে।
শুরু থেকেই সরকারের মধ্যে এই আন্দোলনে জড়িত ছাত্রছাত্রীদের হেয় করে কথা বলতে দেখা যায়। আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায়। সরকার ভুলে গিয়েছিলেন যে তারা দয়ার জন্য আসেনি। বরং এটা একটা অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সকল ভুল বুঝাবুঝির শুরু এই একটা জায়গা থেকেই। সরকার আন্তরিক হতে পারতেন। যেভাবে সরকারি বাহিনী ছাত্র ছাত্রীদের দিকে গুলি ছুড়েছে, সাঁজোয়া যান নামিয়েছে, হেলিকপ্টার উড়িয়েছে – দেখে তো মনে হয় ভিনদেশি শত্রু দেশ দখলের জন্য আক্রমণ করেছে। আর তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছে সরকার। নাহলে নিজের দেশের ছাত্রদের বুকে, সাধারণ জনগণের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি দিয়ে এভাবে নির্দয় হয়ে পাখির মত মানুষ খুন করতে পারে কেউ? বরং সরকারের উচিত ছিল প্রথম থেকে দায়সারাভাবে মন্তব্য না করে, বেফাঁস কথাবার্তা না বলে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে না দেখে তাদের ডেকে এনে আলোচনায় বসানো। কথা বলে সুরাহা কথা। সরকার এই জায়গায় মারাত্মক অদূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছে। তাদের মাথায় রাখা দরকার ছিল এই দেশের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী যুগান্তকারী সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা।
পরস্পর সাংঘর্ষিক বা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেককারী অনেকগুলো কাজ সরকার করেছে এরই মধ্যে। তার একটা হলো ছাত্রলীগ আর ছাত্রদের মুখোমুখি করে দিয়েছে। অথচ চাইলে সরকার ছাত্রলীগকে সাধারণ ছাত্রদের বন্ধু ও আন্দোলনের দাবী আদায়ে সমন্বয়ক হিসেবেও তুলে ধরতে পারতো। এটা স্পষ্টতই প্রকাশ করে সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও ছাত্রলীগ এক নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে। প্রধানমন্ত্রী এরমধ্যে দুইবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছে। দুইবারই মানুষের হাসির পাত্র হয়েছেন। যিনি নিজে স্বজন হারিয়েছেন, সেই তিনিই অন্যের স্বজন হারানোর কারণ হলেন। তাই স্বজন হারানোর বেদনার কথা বলে কান্না করে দেয়ার বিষয়টা বোধহয় জনগণ আর গ্রহণ করছে না। উপরন্তু, আন্দোলনের মাঝখানে দুষ্কৃতিকারীরা দেশের যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়েছে সেসব দেখার পর উনার কান্না দেখে মনে হয়েছে মানুষের প্রাণের চেয়ে স্থাপনা বেশি মূল্যবান। এছাড়াও সারাদেশে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সমন্বয়কারীদের তুলে এনে বার বার হয়রানি করাটা খুবই কাঁচা কাজ বলে মনে হয়েছে। যাদের নেতৃত্বে দেশে এতকিছু ঘটে গেলো, সরকার কিভাবে ভাবলো মেরে-ধরে তাদের থামানো যাবে? সেই কবে তারা মৃত্যুর ভয়কে জয় করেছে তা সরকার নিশ্চয় জানে না। তাদের আরও বুঝার দরকার ছিল, দেশে এমন আন্দোলন হলে জামাত-শিবির-বিএনপি বসে থাকবে না। সুযোগ তারা নিবেই।
সরকার যত বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততই তারা জনগণ থেকে দূরে সরে যাবে – এটাই সত্য। এই ‘দূরে চলে যাওয়ার সরকারকে অদূরদর্শী করে তুলেছে। আর এই অদুরদর্শিতা হাসিনা সরকারের জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান দিয়েছে, তা তাদের গদি থেকে পর্যন্ত নামিয়ে দিতে পারে। এখন বরং খাল কেটে কুমির আনলো। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোলো। এই ঘটনা আওয়ামী লীগের ভেতরেও এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে বলে মনে হয়। এইতো গতকালের ঘটনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গেলেন তার দলের সাবেক ছাত্রনেতাদের সাথে মতবিনিময় করতে। সেখানে এক পর্যায়ে ‘ভুঁয়া-ভুঁয়া’ দুয়োধ্বনিতে সময়ের আগেই বের হয়ে আসতে হলো তার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। জনপ্রিয়তা, গণতন্ত্র, ক্ষমতায় টিকে থাকা, সম্মান – সবকিছুর মাপকাঠিতে আওয়ামী লীগ এবার ধরাশায়ী। এখন দেখার বিষয়, কি হয় দেশের। এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ।