খোলা বাকসো

বন্ধুরা, আপনারা শুনছেন রেডিও জোনাকি এফ এম ৩৪.৯০। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো একঘন্টা। এখন ঘড়িতে ১১টা বেজে ৩০ মিনিট। সময় হয়ে গেলো আজকের মতো বিদায় নেয়ার। তবে মন খারাপের কিছু নেই। বিরতির পর আপনাদের সবার প্রিয় অনুষ্ঠান ‘খোলা বাকসো’ নিয়ে ফিরে আসবে আর.জে. কিশোর। কোত্থাও যাবেন না, আমাদের সাথেই থাকুন, আর শুনতে থাকুন মিনার রহমানের ‘কেউ কথা রাখেনি’। রেডিওতে বাজছে…

কেউ কথা রাখেনি ভালোবাসেনি

কেউ চুপি চুপি পায় কাছে আসেনি,

কেউ গোধূলি বেলায় দু’হাত বাড়িয়ে

খুব আদর মেখে আর ডাকেনি।

আর ডাকেনি…

  • কিরে কিশোর, মন খারাপ মনে হচ্ছে?
  • হ্যাঁ, আপনাকে তো বলাই হয়নি, পরশুদিন রাতে আমার এক ফ্রেন্ড গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। শুভ্র নাম তার। ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলো। যমুনার ঐ প্রান্তে হয় দুর্ঘটনাটা। আমার ঐ ফ্রেন্ডটা বসে ছিলো সামনের দিকেই। জাস্ট এক সারি পর। বি – ২ তে। ওভারটেক করতে গিয়ে গাড়ির ডান পাশটায় ধাক্কা লাগে। গাড়ি উল্টে গিয়ে পাশের দিঘিতে পড়ে যায়। পরে গাড়ির ভেতর থেকেই তার মৃত লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
  • আর বইলেন না, ড্রাইভারগুলো যে কি খেয়ে গাড়ি চালায়… সব মুর্খের দল। রাস্তার নিয়ম কানুন বুঝেনা কিছুই। আসছে গাড়ি চালাইতে। যাহোক, গান শেষের দিকে, আপনি শুরু করেন।

“…ঘর ছাড়া বাতাস হয়ে তোমায় ভাসাতে চাই

পালতোলা নৌকায় আবার হারাবো,

ঘুম ভাঙ্গা সকাল হয়ে তোমায় হাসাতে চাই

চোখজুড়ে স্বপ্নে উড়ে বেড়াব”

হ্যালো বন্ধুরা, মিনারের গানটা নিশ্চয়ই সবার ভালো লেগেছে। মিনারের গান আমার খুব পছন্দের। যাহোক, মনটা ভীষণ খারাপ। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। স্কুল, কলেজ একসাথে পড়েছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আলাদা হয়ে যাই। সে চলে যায় রাজশাহীতে, আর আমি চট্টগ্রামে। মন চাইছিলোনা ঘর থেকে বের হতে, তাও জোর করে চলে আসলাম। ভাবলাম, ঘরে চার দেয়ালে আঁটকে রাখলে মনটা বরং আরও খারাপ হবে। তারচেয়ে রেডিওতে চলে যাই, আপনাদের মনের কথা শুনি, তাতে ভেতরটা হালকা হবে।

যাহোক, শুরু করছি আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান, খোলা বাকসো। অনেকেই আমাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে একটা চিঠি পড়বো আজ। দেখি প্রডিউসার কার চিঠিটা বেছে নিলেন…

প্রিয়তম,

জানিনা কেমন আছো। এক বুক আক্ষেপ নিয়ে লিখতে বসলাম। তোমার অনুপস্থিততে, এই বিশেষ দিনে প্রথমদিকের স্মৃতিগুলো আনমনে হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠছে বারবার। মনে আছে তোমার সে রাতের কথা? আকাশে পূর্ণিমার  চাঁদ। মোলায়েম আলোয় চারদিকে অদ্ভুত একটা মুগ্ধতা বিরাজ করছিলো। আমি চাঁদ দেখতে বেরিয়েছি হল থেকে। বের হওয়ার পথে দেখি, তুমি একা সেন্ট্রাল ফিল্ডে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছো অনেক্ষন ধরে। দূর থেকে এই অদ্ভুত কান্ড দেখে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখা, অথচ অনেককিছু জিজ্ঞেস করেছি সেদিন তোমাকে। উত্তর দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু একবারও আমার দিকে চোখ ফেরালেনা। তাতে অবাক হয়নি মোটেও। মনে মনে ভেবেছি, আমি নিশ্চয়ই চাঁদের চেয়ে সুন্দর নই… এই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি বলেছিলে, এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি মনের সব বিষন্নতা উবে যায়, সব কালিমা সাফ হয়ে যায়।

এরপর থেকে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম পূর্ণিমার জন্য। পূর্ণিমা রাতে, দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম প্যারিস রোড ধরে, অনেক গল্প হতো। শেষে সেই সেন্ট্রাল ফিল্ডে এসে দুজনে শুধু আঁকাশের ঐ চাদটার দিকে চেয়ে থাকতাম। কোন কথা নয়, শুধু চাঁদ দেখা। আবছা ধূসর মেঘ, গা জুড়ানো মৃদু বাতাস আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতাম সারারাত।

প্রতিবার এনিভার্সারিতে তোমার কতো প্রস্তুতি, কতো তোরজোড়। সেদিক থেকে আমি একটু পিছিয়ে ছিলাম অবশ্যই। প্রতিবারই আমার জন্য কতো সারপ্রাইজ রাখতে! তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চলে যাও, আমি ভীষণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিনের অফিসের খাটুনি শেষে, পাঁচটায় রউনা দিয়ে, টানা ছয় ঘন্টার জার্নি শেষে এখানে এসে পৌঁছাতে – শুধু একটা রাত প্যারিস রোডে হাঁটার জন্য, খোলা আঁকাশের নীচে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে কাটানোর জন্য। আমার কি ভীষণ আনন্দ হতো তখন। মনে হতো, পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা আমার আনন্দের কাছে যেন ম্লান হয়ে গেছে।  

কাল আমাদের এনিভার্সারি ছিলো। ফোন দিয়েছিলাম কবার, ধরোনি। শুধু একটা টেক্সট করেছিলে। মনে আছে, বারবার রূপার কথা বলতে আমাকে? সে রূপার আজ মতো নীল শাড়িতে সেজে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। ভেবেছি, সারপ্রাইজ হয়তো। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এসে একবার দেখা দিবে। কই, আসোনি তো। এই না আসাটাই কি এবারের সারপ্রাইজ তাহলে? আমি সারারাত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। আচ্ছা, অভিমান করোনি তো? অভিমান করার মতো তো কিছু করিনি আমি। বরং আমারই তো অভিমান করার কথা…

শোন শুভ্র, নীল শাড়িটা এখনও গায়ে জড়িয়ে রেখেছি। পূর্ণিমা হয়তো নেই, কিন্তু চাঁদটা ঠিকই আছে আঁকাশে। আমরা আবার প্যারিস রোডে হাটবো, আঁকাশের চাঁদ দেখবো। অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি, তোমার রোশনি।

কিশোরের গলা ধরে এসেছে। কথা বলতে পারছেনা। শুধু চোখ বেয়ে জল পড়ছে অনবরত।