অন আ ব্রেক

ঘড়িতে যখন সকাল সাড়ে ছয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে একটু হকচকিয়ে গেলো রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “কি খবর? কেমন যাচ্ছে সবকিছু?” শীতের সকাল। অন্যদিন হলে শীতকে জয় করে গায়ে জড়ানো লেপ ছেড়ে হিমশীতল পানিতে মুখহাত ধুতেই পাক্কা একঘন্টা লাগিয়ে দেয়ার কথা। আজকে তার ব্যতিক্রম। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রিশান। জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নন্দনকাননের যে বাড়িটায় থাকে, সেখান থেকে জানালা দিয়ে ডিসি হিলের খুব সুন্দর একটা অংশ দেখা যায়। কৃষ্ণচূড়ার গাছটা লালে-লাল হয়ে আছে। কোথা থেকে একটা শালিক পাখি এসে বসেছে। এই বাসাটায় রিশান আছে গতো তিন বছর ধরে। প্রতিদিন কাঁক দেখা যায়, চড়ুই দেখা যায়, মাঝে মাঝে ময়নাও দেখা যায়। কিন্তু শালিক কখনো চোখে পড়েনি তার। পাখিটার দিকে গভীর মনোযোগে তাকাতেই একসাথে অনেকগুলো স্মৃতি ধরা দিলো। যেন শালিকটা দুইপাখা বোঝাই করে এনেছে সেগুলো। যেই স্মৃতি রোমন্থনে ডুব দিবে, অমনিতে বিকট শব্দে তার মনোযোগ ভিন্নদিকে চলে গেলো। মোড়ের ট্রান্সফরমারটা ফুটে গেছে। পরক্ষনে অনেকগুলো কাঁককে দেখা গেলো কাঁ-কাঁ করতে ঝাক বেঁধে ওদিকে যেতে। তাদের দলের কোন কাঁক হয়তো মারা গেছে ঐ ট্রান্সফরমারে।

সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরে ভার্সিটিতে যাবে রিশান। এরই মধ্যে বিশ মিনিট চলে গেছে। আপাতত স্মৃতিচারনের সময় নেই। কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে শীতের কাপড়টা গায়ে চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। একটা রিকশা নিয়ে পৌঁছে যায় ষ্টেশনে। এখন আর আগের মতো ফ্যামিলি বগিতে বসার তাড়া নেই। শাটলে পলিটিক্স বন্ধ করে দেয়ায় রিশানের ভালোই হয়েছে। কোন একটাতে উঠে গেলেই হলো, সোজা ভার্সিটি পৌঁছে যাওয়া যায়। একটু পর শাটল চলতে শুরু করলো। জানালার পাশের একটা সিটে রিশান বসে আছে। ব্যাগ থেকে সমরেশ মজুমদারের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ বের করেছে। বই খুলে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ার আগ্রহ নেই। তাঁর মনোযোগের পুরোটা জুড়ে তানিশার ঐ টেক্সটটা। আবার সে ভাবনার রাজ্যে ডুব দিলো…

তানিশার সাথে তাঁর দেখা হয় ভার্সিটি কোচিং এর সময়। প্রথমে ক’দিন চকবাজারে করলেও এতো লোকের আনাগোনা ভালো না লাগায় জিইসিতে চলে আসে রিশান। সেখানেই তাদের দেখা। দুজনই পড়াশুনায় ভালো। কোচিং এর মডেল টেস্টে প্রথম দিকে থাকতো তারা। একজন আরেকজন থেকে নোট ধার নিতো, পড়া বুঝিয়ে নিতো। আবার কোনদিন দুজনে বই নিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। কাজের-অকাজের কথা, নিয়মিত দেখা হওয়া, একই ভালো লাগার বিষয় – একটা ফ্রেন্ডশিপকে এগিয়ে নেয়ার উপঢৌকন হিসেবে যা দরকার, তার সব ছিলো তাদের মধ্যে। ঐ উঠতি বয়সে যেমনটা হয়, কোচিং এর এক ছেলেকে ভালো লাগা শুরু হয় তানিশার। ছেলে মানে, কোচিং এ ক্লাস নেন। সাধারণ জ্ঞানটা ভালোই পড়ায়। ভালো লাগার ব্যাপারটা রিশানকে জানায় সবার আগে। প্রেমট্রেম নিয়ে রিশানের খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। রিশান টুকটাক পরামর্শ দিতো আর সুযোগ বুঝে মজা করতো, খেপাতো। কিন্তু তানিশা’র আগ্রহের তীব্রতা দেখে তার অস্বস্তি শুরু হয়।

অজান্তে বন্ধুর চেয়ে বিশেষ কোন জায়গা দিয়েছিলো তানিশাকে? নাকি উঠতি বয়সের মায়া? এসব প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খায়। এদিকে তানিশাও অবস্থা বুঝে দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেই যে দূরে চলে যাওয়া, আর কাছে আসা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি। অবশ্য, যোগাযোগ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেটা বললে খানিকটা ভুল হবে। রিশান টুকটাক খবরাখবর রাখতো। জেনেছিলো, ছেলেটার সাথে নাকি একসময় সত্যি সত্যি সম্পর্কে জড়ায় তানিশা। তারপর আর কি হলো তার ধারণা নেই। শাটল ভার্সিটির ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে। রিশান গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত সকালের নাস্তাটা সেরে ক্লাস ধরতে গেলো।

সারাদিন ঝামেলার মধ্যে টেক্সটের উত্তর দিতে ভুলে গেছে রিশান। খেয়ালই ছিলনা। সেদিন সন্ধায় বাসায় ফিরে ফোন হাতে নিলো উত্তর দিবে ভেবে। আরেকটা টেক্সট এসেছে তানিশার নাম্বার থেকে। “বুঝতে পেরেছি, বহুদিনের চাপা ক্ষোভের ভার উপড়ে উত্তর দেয়ার আগ্রহ পাওনি হয়তো। কাল বিকেল পাঁচটায়, রিওতে চলে এসো”। রিশান এবার অনেকটা দায়সারা উত্তর দিলো – “আচ্ছা”।  

তানিশা আগে এসেছে। দরজায় অপেক্ষা করছে রিশানের জন্য। রিকশা থেকে নামতেই যখন তানিশাকে চোখে পড়লো। দুই বছরে অনেক বদলেছে সে, কিন্তু একেবারে না চেনার মতো নয়। এক চিলতে মুচকি হাসি আর ভাব বিনিময়ের পর দুজনে উপরে উঠে গেলো। ক্যাফের দক্ষিন পাশটা একটু নিরব। সেখানের দুটো চেয়ারে বসে আলাপ শুরু হলো তাদের। নিজের জন্য একটা লাটে অর্ডার করেছে। রিশান কিছু খেতে চায়নি। পরে অনেকটা জোরাজোরির পর একটা এস্প্রেসো দিতে বলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কতোকিছু উঠে আসে সেদিন। পরিবার, পড়াশুনা, ভবিষ্যৎ ভাবনা সহ কতো কিছু। কিন্তু একটা বিষয় বেশ সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেলো তানিশা – ব্যক্তিগত জীবন। রিশানও বুঝতে পেরে খুব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হয়তো ভালো যাচ্ছে না। বুঝতে অসুবিধে হলো না, কৈশোরের অস্থিরতা আর নেই। শান্ত আর ধিরস্থির আর সবকিছুতে পরিপক্ষতার ছাপ। এতোদিন পরে দেখা, কিন্তু আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই কথায়। একদম ভার্সিটি কোচিংয়ের দিনগুলোর মতো। পারলে খানিকটা বেশী বলা চলে। অনেকদিন পর দেখা বলে এমনটা হতে পারে। কে জানে?

ছেলেমানুষী স্রোত নাকি বর্ষায় তীব্র হয়, চৈত্রে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু নদীতে বোধ হয় বর্ষা ফিরে এসেছে। স্রোত তার তীব্রতা ফিরে পেয়েছে ধীরে। রিশান আর তানিশা ঘন্টার পর ঘন্টা বাতিঘরে বই বাছাই করে কাটিয়েছে, রিকশায় সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে বা কোনদিন ভোরে দুজনে সিআরবি’তে চরকির মতো ঘুরেছে – এভাবে নানান ছলে দুজনের কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে, ভাবের বিনিময় হয়েছে, আর সম্পর্কটা পরিপক্ষ হয়েছে।

কোন এক সকাল। ঘড়িতে যখন সকাল নয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। রিও’তে বিকাল চারটা”। শনিবার, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এদিকে তানিশার সাথে দেখা হবে বিকালে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠার তাড়া নেই রিশানের। বিছানায় শুয়েই জানালার বাইরেরটা দেখা যায়। হঠাত মনে হলো, আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। কি যেন নেই-নেই ভাব। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো, ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো রিশান। কৃষ্ণচূড়া গাছ, টকটকে লাল ফুল, আর পরিচিত পাখিগুলো – সবই তো আছে। তবুও এমন মনে হচ্ছে কেন? সারাদিনটা তার কেমন এক বিষন্নতায় কাটলো। বিকালে বেরিয়েছে। রিওতে পৌঁছে দেখে বসে আছে তানিশা। নাহ, শুধু তানিশা না… সাথে আরেকজন। আরেকটা ছেলে। দূর থেকে দেখে মনে হলো, খুব পরিচিত চেহারা। হ্যাঁ, ওই যে… কোচিং এ যে ছেলেটা ক্লাস নিতো। রিশান বুঝে উঠতে পারছেনা। যেন হঠাত তার মাথায় আঁকাশ ভেঙ্গে পড়লো। দূর থেকে দেখে আর সামনে পা বাড়ায়নি। নীচে নেমে ফোন দেয় তানিশাকে।কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, এখনও আসতে পারলেনা না? তানিশা বলে উঠে।

আগে বলো ঐ লোকটা কে।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো। তার জন্যই তো আজকে দেখা করতে চাইলাম!

না, যা বলার এখানেই বলো।

তানিশা একটু থামলো। তারপর নিচু গলায় বললো…সজীব।

তা আমি চিনেছি। কিন্তু সে এখানে কি করছে?

ফোন কেটে দিলো তানিশা। রিশানও চলে গেলো। একটা রিকশা ভাড়া করে চললো বাসার দিকে। আরেকটা টেক্সট এসেছে, তানিশার কাছ থেকে। তানিশা লিখেছে – “We were on a break”

খোলা বাকসো

বন্ধুরা, আপনারা শুনছেন রেডিও জোনাকি এফ এম ৩৪.৯০। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো একঘন্টা। এখন ঘড়িতে ১১টা বেজে ৩০ মিনিট। সময় হয়ে গেলো আজকের মতো বিদায় নেয়ার। তবে মন খারাপের কিছু নেই। বিরতির পর আপনাদের সবার প্রিয় অনুষ্ঠান ‘খোলা বাকসো’ নিয়ে ফিরে আসবে আর.জে. কিশোর। কোত্থাও যাবেন না, আমাদের সাথেই থাকুন, আর শুনতে থাকুন মিনার রহমানের ‘কেউ কথা রাখেনি’। রেডিওতে বাজছে…

কেউ কথা রাখেনি ভালোবাসেনি

কেউ চুপি চুপি পায় কাছে আসেনি,

কেউ গোধূলি বেলায় দু’হাত বাড়িয়ে

খুব আদর মেখে আর ডাকেনি।

আর ডাকেনি…

  • কিরে কিশোর, মন খারাপ মনে হচ্ছে?
  • হ্যাঁ, আপনাকে তো বলাই হয়নি, পরশুদিন রাতে আমার এক ফ্রেন্ড গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। শুভ্র নাম তার। ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলো। যমুনার ঐ প্রান্তে হয় দুর্ঘটনাটা। আমার ঐ ফ্রেন্ডটা বসে ছিলো সামনের দিকেই। জাস্ট এক সারি পর। বি – ২ তে। ওভারটেক করতে গিয়ে গাড়ির ডান পাশটায় ধাক্কা লাগে। গাড়ি উল্টে গিয়ে পাশের দিঘিতে পড়ে যায়। পরে গাড়ির ভেতর থেকেই তার মৃত লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
  • আর বইলেন না, ড্রাইভারগুলো যে কি খেয়ে গাড়ি চালায়… সব মুর্খের দল। রাস্তার নিয়ম কানুন বুঝেনা কিছুই। আসছে গাড়ি চালাইতে। যাহোক, গান শেষের দিকে, আপনি শুরু করেন।

“…ঘর ছাড়া বাতাস হয়ে তোমায় ভাসাতে চাই

পালতোলা নৌকায় আবার হারাবো,

ঘুম ভাঙ্গা সকাল হয়ে তোমায় হাসাতে চাই

চোখজুড়ে স্বপ্নে উড়ে বেড়াব”

হ্যালো বন্ধুরা, মিনারের গানটা নিশ্চয়ই সবার ভালো লেগেছে। মিনারের গান আমার খুব পছন্দের। যাহোক, মনটা ভীষণ খারাপ। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। স্কুল, কলেজ একসাথে পড়েছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আলাদা হয়ে যাই। সে চলে যায় রাজশাহীতে, আর আমি চট্টগ্রামে। মন চাইছিলোনা ঘর থেকে বের হতে, তাও জোর করে চলে আসলাম। ভাবলাম, ঘরে চার দেয়ালে আঁটকে রাখলে মনটা বরং আরও খারাপ হবে। তারচেয়ে রেডিওতে চলে যাই, আপনাদের মনের কথা শুনি, তাতে ভেতরটা হালকা হবে।

যাহোক, শুরু করছি আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান, খোলা বাকসো। অনেকেই আমাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে একটা চিঠি পড়বো আজ। দেখি প্রডিউসার কার চিঠিটা বেছে নিলেন…

প্রিয়তম,

জানিনা কেমন আছো। এক বুক আক্ষেপ নিয়ে লিখতে বসলাম। তোমার অনুপস্থিততে, এই বিশেষ দিনে প্রথমদিকের স্মৃতিগুলো আনমনে হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠছে বারবার। মনে আছে তোমার সে রাতের কথা? আকাশে পূর্ণিমার  চাঁদ। মোলায়েম আলোয় চারদিকে অদ্ভুত একটা মুগ্ধতা বিরাজ করছিলো। আমি চাঁদ দেখতে বেরিয়েছি হল থেকে। বের হওয়ার পথে দেখি, তুমি একা সেন্ট্রাল ফিল্ডে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছো অনেক্ষন ধরে। দূর থেকে এই অদ্ভুত কান্ড দেখে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখা, অথচ অনেককিছু জিজ্ঞেস করেছি সেদিন তোমাকে। উত্তর দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু একবারও আমার দিকে চোখ ফেরালেনা। তাতে অবাক হয়নি মোটেও। মনে মনে ভেবেছি, আমি নিশ্চয়ই চাঁদের চেয়ে সুন্দর নই… এই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি বলেছিলে, এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি মনের সব বিষন্নতা উবে যায়, সব কালিমা সাফ হয়ে যায়।

এরপর থেকে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম পূর্ণিমার জন্য। পূর্ণিমা রাতে, দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম প্যারিস রোড ধরে, অনেক গল্প হতো। শেষে সেই সেন্ট্রাল ফিল্ডে এসে দুজনে শুধু আঁকাশের ঐ চাদটার দিকে চেয়ে থাকতাম। কোন কথা নয়, শুধু চাঁদ দেখা। আবছা ধূসর মেঘ, গা জুড়ানো মৃদু বাতাস আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতাম সারারাত।

প্রতিবার এনিভার্সারিতে তোমার কতো প্রস্তুতি, কতো তোরজোড়। সেদিক থেকে আমি একটু পিছিয়ে ছিলাম অবশ্যই। প্রতিবারই আমার জন্য কতো সারপ্রাইজ রাখতে! তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চলে যাও, আমি ভীষণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিনের অফিসের খাটুনি শেষে, পাঁচটায় রউনা দিয়ে, টানা ছয় ঘন্টার জার্নি শেষে এখানে এসে পৌঁছাতে – শুধু একটা রাত প্যারিস রোডে হাঁটার জন্য, খোলা আঁকাশের নীচে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে কাটানোর জন্য। আমার কি ভীষণ আনন্দ হতো তখন। মনে হতো, পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা আমার আনন্দের কাছে যেন ম্লান হয়ে গেছে।  

কাল আমাদের এনিভার্সারি ছিলো। ফোন দিয়েছিলাম কবার, ধরোনি। শুধু একটা টেক্সট করেছিলে। মনে আছে, বারবার রূপার কথা বলতে আমাকে? সে রূপার আজ মতো নীল শাড়িতে সেজে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। ভেবেছি, সারপ্রাইজ হয়তো। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এসে একবার দেখা দিবে। কই, আসোনি তো। এই না আসাটাই কি এবারের সারপ্রাইজ তাহলে? আমি সারারাত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। আচ্ছা, অভিমান করোনি তো? অভিমান করার মতো তো কিছু করিনি আমি। বরং আমারই তো অভিমান করার কথা…

শোন শুভ্র, নীল শাড়িটা এখনও গায়ে জড়িয়ে রেখেছি। পূর্ণিমা হয়তো নেই, কিন্তু চাঁদটা ঠিকই আছে আঁকাশে। আমরা আবার প্যারিস রোডে হাটবো, আঁকাশের চাঁদ দেখবো। অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি, তোমার রোশনি।

কিশোরের গলা ধরে এসেছে। কথা বলতে পারছেনা। শুধু চোখ বেয়ে জল পড়ছে অনবরত।

নীল খাম

নেদারল্যান্ড বললেই চট করে আমস্টারড্যাম বা দ্যা হেইগের কথা মাথায় চলে আসে। এই গল্পটা নেদারল্যান্ডের হলেও শহর দুটির কোনটার সাথে সম্পৃক্ত নয়। নর্থ সি’র কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠা ছোট্ট শহর লেইডেন। এই শহরটাকে অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরেছে রিন নদী।

হেমিংওয়ে। ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। জন্মসূত্রে আমেরিকান, তবে থিতু হয়েছে নেদারল্যান্ডে। পড়াশুনার বিষয় পদার্থবিজ্ঞান হলেও ছোটবেলা থেকে লেখালেখির প্রতি অগাধ আগ্রহ তার। হাইস্কুলে থাকাকালীন একটানা চারবছর অ্যানুয়্যাল রাইটিং কম্পিটিশনে প্রথম হয়েছিলো সে। লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পদার্থবিজ্ঞানের মতো এমন খটমটে একটা বিষয়ে স্নাতক করার পরও লেখালেখি থেকে দূরে সরে আসেনি। ছাত্রদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ম্যায়ার’ এর প্রতি সংখ্যায় হেমিংওয়ের একটা লেখা সবসময়ই থাকতো। এই লেখালেখির সুবাধে ক্যাম্পাসে তার জনপ্রিয়তাও ছিল বেশ। যাহোক, পড়াশুনা শেষে স্থানীয় এক দৈনিকে সাব এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছে হেমিংওয়ে। সাহিত্য পাতাটা সে দেখে। বিভিন্নজন লেখা পাঠান, সেসব লেখা ঘষামাজা করা তার কাজ। অফিসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। যখন খুশি যায়, যখন খুশি আসে। অধিকাংশ সময়ই বাইরে থেকে অফিসের কাজ সারে। বাইরে মানে, তার প্রিয় উডস রেস্তোরাঁয়।

লেইডসোয়েগে একা একটা বাসায় থাকে হেমিংওয়ে। সেখান থেকে গাড়িতে করে উডসে আসতে বার মিনিটের পথ। প্রায় প্রতিদিনই একই সময়ে আসে, একই টেবিলে বসে এবং একই খাবার অর্ডার করে – ব্রুশ্যাটা, পানি এবং লাল চা। রিন নদীর তীরে এই রেস্তোরাঁটার অবস্থান। এর ছাদের উপর একটা বহুদিনের পুরোনো উইন্ডমিল আছে বলে সহজেই দূর থেকে দেখে চেনা যায়।

রয় হেমিংওয়ের পুরোনো বন্ধু। একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। তার বাবামা ভারতীয়। নেদারল্যান্ড এসেছে অন্তত দশক দুয়েক আগে, যখন তার বয়স চার কি পাঁচ। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের কিছুই তার স্মৃতিতে নেই। সে হিশেবে পুরোদস্তর ডাচ বলা চলে। এখন ফুলটাইম ফটোগ্রাফার আর পার্ট টাইম হেমিংওয়ের আড্ডার সঙ্গী। রয় যতক্ষণে হেমিংওয়ের সাথে যোগ দেয় ততক্ষণে তার অফিসের নিয়মিত কাজ শেষের দিকে। তাই বাকি সময় জমিয়ে আড্ডা দেয়া যায়। সাধারণত আড্ডার বিষয় সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি এসব। আর মাঝে মাঝে মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়াদি।

রয় সেদিন আসেনি। অফিসের কাজও দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত একটা এসাইনম্যান্ট শেষ করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কোনোভাবেই মাথা থেকে লেখাটা বের হচ্ছিলোনা। হাঁসফাঁশ করছে আর নিজের চুল টানাটানি করছে। এর মধ্যে কারা যেন তাকে দেখে সশব্দে হেঁসে দিলো। ল্যাপটপ থেকে ডানে চোখ ফিরাতেই চোখে পড়ে একজন রমণী। পাশের টেবিলে একা বসে আছে। আসলে মেয়েটা হাসেনি, হেসেছে অন্যকেউ। বেশ লম্বা-চৌড়া, চেহারা লাবণ্যময়, আর পরনে মার্জিত পোশাক। প্রথম দেখাতেই চোখ আঁটকে যাওয়ার মতো। কি যেন ভাবছে আর আনমনে কিন্ড্যালটা নাড়াচাড়া করছে। যাহোক, চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো হেমিংওয়ে।

একটু পর রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু গোছগাছ করার প্রক্রিয়া চলছে। হেমিংওয়েও বের হবে, এমন সময় হঠাত একটা মেয়ে দৌড়ে আসলে। ভুলে কিন্ড্যালটা নাকি ফেলে গেছে, সেটা নিতে এসেছে। প্রথম দেখাতেই চিনে ফেললো হেমিংওয়ে। এইতো সেই মেয়েটা। কাউন্টার থেকে কিন্ড্যালটা সংগ্রহ করার পর বের হওয়ার পথে সামনাসামনি দেখা। অনেকটা সেধে গিয়ে হাই-হ্যালো করলো হেমিংওয়ে। কিছুক্ষন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথাও হলো। মেয়েটার বেশ আগ্রহ নিয়ে আলাপচারিতা করলো। তার নাম ক্রিস্টিন। ডাচ নাগরিক। লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক করছে। উডস সম্পর্কে জানতে পারে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় সাধারনত উডস-এ আসা হয়না। আজকে কি ভেবে এক ফাঁকে চলে এসেছে।

অনেকদিন ক্রিস্টিনের দেখা নেই। হেমিংওয়ে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। রয় যখন মন চায় আসে, আড্ডা দেয়। যখন মনে চায়না, আসেনা। এভাবে প্রায় মাস খানেক পেরিয়ে গেলো। কোন এক বিকেল বেলা। হেমিংওয়ের কাজ শেষ। রয়ের সাথে আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয় ফরাসি বিপ্লব। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উয়াদারনীতিবাদ আর নেপোলিয়ায়নের উত্থান – এসব বিষয়ে ইনটেন্স বিতর্ক-আলোচনা চলছিল দুজনের মধ্যে। হঠাত কেউ একজন হেমিংওয়ের নাম ধরে ডাক দিলো। মাথা উঁচু করে একবার তাকাতেই চিনে ফেলে – এতো ক্রিস্টিন! হেমিংওয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় – ক্রিস্টিন, এ হচ্ছে আমার বন্ধু আর আড্ডার সঙ্গী, রয়। রয়, এ হলো ক্রিস্টিন, আমার বান্ধবী। যার কথা সেদিন তোমাকে বলেছিলাম।

ক্রিস্টিন জানতে চায়, তা কি নিয়ে এতো মনোযোগ দিয়ে গল্প হচ্ছিলো শুনি…

অবশ্যই, ফরাসি বিপ্লব, হেমিংওয়ে জবাব দেয়।

ফরাসি বিপ্লব? সিরিয়াসলি? এটাও আড্ডার বিষয় হতে পারে? ক্রিস্টিন জানতে চায়।

রয় বলে উঠে, এতো অবাক হওয়ার কি আছে? প্রতিদিনই তো এই কাজটা করি। যেমন ধরো গতোকাল আলাপ করেছি রেনেসাঁস নিয়ে। তার আগের দিন বার্লিন দেয়ালের উত্থান পতন আর তারপরদিন…

থাক থাক থাক, আর বলতে হবেনা – এই বলে থামিয়ে দেয় ক্রিস্টিন।

আলোচনায় বিষয় বদলে যায়। হেমিংওয়ে আর রয় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে বেশ কিছুদিন হলো। এর মধ্যে ক্যাম্পাস অনেক বদলে গেছে। ক্রিস্টিনের উপস্থিতিতে সেদিনের আড্ডাটা বেশ জমে উঠে। স্মৃতিচারণ চলে ক্লাসের নানান গল্প আর মজার ঘটনাদি নিয়ে। এরপর থেকে যখনই সময় পায়, উডসে চলে আসে ক্রিস্টিন। এভাবে একসময় হেমিংওয়ে আর রয়ের আড্ডার গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হয়ে উঠে সে। সারাদিন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে, আর বিকালে বেলা উডসে এসে আড্ডা দেয়। এর মধ্যে আড্ডার বিষয়েও বেশ বিচিত্রতা এসেছে। সিরিয়াস বিষয়ের পাশপাশি এখন খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়েও তিনজনের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ হয়।

তবে ক্রিস্টিনের প্রভাব শুধু আলোচনার বিষয়ে পড়েছে সেটা বললে ভুল বলা হবে। তার প্রভাব পড়েছে হেমিংওয়ের মনেও। দেখতে সুন্দরী নিঃসন্দেহে। তার উপর সিয়িয়াস কিংবা তুচ্ছ বিষয়ে ক্রিস্টিনের দৃষ্টিভঙ্গি বা আলোচনার ধরণ সত্যি অনন্য। নিয়মিত গালগল্পের মাঝেমাঝে ব্যক্তিগত বিষয়াদি উঠে আসে। বাড়তে থাকে হেমিংওয়ের অনুভূতিগুলোও। নিজের ভেতর এতোকিছু ঘটছে, কাউকে তো বলতে হয়। ক্রিস্টিনের অনুপস্থিতিতে রয়ের সাথে একদিন কথাগুলো ভাগাভাগি করে হেমিংওয়ে। রয় তার কথা শুনে বেশ শকড হয়। তারও ভালো লাগে ক্রিস্টিনকে। সেও এতোদিন কাউকে বলেনি কিছু। এরমধ্যে তার বন্ধুর ভালোলাগার কথা শুনে কুলিয়ে উঠতে পারেনা। অনেকটা জোর করে মাথা থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে সে। হাজার হোক, বন্ধু তো। সে চায়না এই বিষয়টা নিয়ে তাদের বন্ধুতে টান পড়ুক। বরং রয় হেমিংওয়েকে নানান সময় পরামর্শ দেয়, চেষ্টা করে বিষয়টাকে সহজভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।  

প্রতিদিন বিকেল বেলা হয়, রয় আসে, কোন কোন দিন ক্রিস্টিনও আসে, জমে উঠে আড্ডা। ক্রিস্টিন থাকলে অনেক কিছু নিয়েই আলাপ হয়। কিন্তু না থাকলে ক্রিস্টিনই হয়ে উঠে দুজনের আলোচনার বিষয়। হেমিংওয়ের এই অবস্থা দেখে রয় পরামর্শ দেয় ক্রিস্টিনকে সোজাসাপ্টা তার অনুভুতির কথা জানিয়ে দেয়ার। হেমিংওয়েও তাই ভাবছে।

এর মধ্যে গ্রীষ্ম চলে এসেছে। চারদিকে মিষ্টি রোদ। সতের ডিগ্রী সেলসিয়াস বলা যায়। ক্যালেন্ডার মতে চব্বিশ জুলাই থেকে পাঁচ সেপ্টেম্বর একটা লম্বা ছুটি পাওয়া গেলো। সবমিলিয়ে ঘুরাঘুরির উপযুক্ত সময়। তিনবন্ধু পরিকল্পনা করে ফ্রান্সের মুজা গ্রামে তারা এই গ্রীষ্মটা কাটাবে। মুজা ফ্রান্সের দক্ষিণের একটা শহর। শিপ্ল সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী পিকাসো। আর সেখানেই ক্রিস্টিনকে ভালো লাগার কথা জানাবে হেমিংওয়ে।

পরদিন বিকাল বেলা। হেমিংওয়ে তো আছেই। আছে রয় আর ক্রিস্টিনও। মুজা গ্রামের কথা শুনে ক্রিস্টিন এক পায়ে খাড়া। গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতেই পারেনা। হেমিংওয়ের ভাষায়, “এতো সুন্দর করে সাজানো, যেন পুরো গ্রামটাই একটা বিশালাকার শিল্পকর্ম। পিকাসোর ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে ধারন করে রেখেছে এই গ্রাম।” গ্রীষ্মের ছুটি আসতে বেশীদিন বাকি নেই। প্রত্যেকেই যে যার মতো কেনাকাটা সেরে নিলো। আরেকদিন বসে ঠিক করলো কোথায় কখন কি করবে সেটা। হেমিংওয়ের উৎসাহ সবার চেয়ে বেশী। তেমন কিছু কিনেনি সে। বিশেষ কিছু বলতে নিজের জন্য ক্রিস্টিনের পছন্দের নীল রঙয়ের একটা ফ্লোরাল শার্ট আর একটা কিন্ড্যাল ওয়াসিস। কিন্ড্যালটা নিজের জন্য নয়, ক্রিস্টিনের জন্য কিনেছে।    

গ্রীষ্মের ছুটি চলে এলো। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সকাল নয়টায় সবার পার্কেরেন লেইডেন-এ চলে আসার কথা। রয় আর ক্রিস্টিন ঠিক সময়ে চলে এসেছে। হেমিংওয়ে এলো সবার শেষে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাকি ব্যাকপ্যাক ছাড়াই চলে এসেছিলো ভুলে। অর্ধেকটা পথ চলে আসার পর হুশ ফিরে তার। ফের গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। 

যাহোক, দীর্ঘ ষোল ঘন্টার জার্নি। কেমন লাগছে? রয় জানতে চায়।

সুপার এক্সাইটেড! ড্রাইভিং নিয়েও সমস্যা হওয়ার কথা না। তিনজনে ভাগাভাগি করে চালিয়ে দেয়া যাবে। ক্রিস্টিন জবাব দেয়।

আমরা আমরাই তো। গল্প করতে করতে পার হয়ে যাবে। যোগ করে রয়।

ব্রাসেলস, লুক্সেমবার্গ, জেনিভা হয়ে কান। সেখান থেকে মুজা একদম কাছেই। এই পথে কখনো যাইনি। জানায়, হেমিংওয়ে।

চলো, শুরু করা যাক বলে সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো। রয় ড্রাইভিং করছে শুরুতে। হেমিংওয়ে আর ক্রিস্টিন পেছনের আসনে বসা। গাড়ি চলছে… ইতিমধ্যে বেলজিয়ামে প্রবেশ করেছে গাড়ি। শুরুতে অনেক হই হুল্লোড় দেখা গেলেও ঘন্টা দুয়েক পর উত্তেজনায় ভাটা পড়লো। ততক্ষোনে পেছনের দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছে। রয় বেচারা ড্রাইভিং সিটে। তাই ঘুমোতে পারছেনা। ওদিকে অন্য দুই বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দেখে সহ্যও হচ্ছেনা। রয়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। খালি রাস্তাতেই নব্বই মাইল বেগে চলা গাড়িতে সজোরে ব্রেক কষলো সে। প্রচন্ড ভয়ে ঘুম থেকে হুমড়ি খেয়ে উঠে পড়ে হেমিংওয়ে আর ক্রিস্টিন। আর তাদের অবস্থা দেখে হাসতে থাকে রয়। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ট্রে তে রাখা পানির বোতল ছুঁড়ে মারে রয়ের দিকে। রয়ের গায়ে লাগেনি বোতল, উল্টো মুখ খুলে পানি ছিটকে সামনে রাখা হেমিংওয়ের ব্যাগে গিয়ে পড়েছে। যাহোক, ছোটখাটো একটা ফাইট শেষে সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে গেলো।

গাড়ি চলছে তো চলছেই… এতোক্ষনে আরও অনেকটু পথ পাড়ি দিয়েছে। মাঝপথে বুর্গ-এন-ব্রিস এর একটা রেস্তোরায় তারা দুপুরের খাবার সেরে নিলো। সুন্দর পরিবেশ। সামনের দিকটা খোলা সবুজ প্রান্তর। খাওয়াদাওয়া সেরে সেখানটায় কিছুক্ষন বসার পর আবার গাড়িতে উঠলো তারা। এবার চালকের আসনে হেমিংওয়ে। গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝে এস্প্রেসোর কাপে চুমুক লাগাচ্ছে। ঘুম কাটানোর জন্য এই প্রচেষ্টা। সুইজারল্যান্ড সীমান্ত পেরিয়ে গেছে গাড়ি। জিপিএস বলছে গাড়ি তখন ট্রেফোর্ট নামের একটা জায়গায়। এর মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। তবে ভয়ের কিছু নেই। পাহাড়গুলো এতোটা উঁচু নয়। গাড়িতে ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস বাজছে। হেমিংওয়ে ভলিউমটা বাড়িয়ে দিলো। দিনের আলো থাকলো ভীষণ ভালোভাবে উপভোগ করা যেতো। এনিয়ে ক্রিস্টিনকে হা হুতাশা করতে দেখা গেলো। হেমিংওয়ে বললো, “চিন্তা করোনা, ক্রিস্টিন। ফেরার সময় যথেষ্ট আলো থাকবে। তখন গাড়ি থামিয়ে প্রান ভরে দেখতে পারবে।” কথা শুনে ক্রিস্টিন মৃদু হাসলো।

হেমিংওয়ে অনেক্ষন ধরে ড্রাইভ করছে। সে বললো, “ক্রিস্টিন, প্রস্তুত হও। সামনে একটা কফিশপ আছে। ওইখান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই আমার কাজ। সেখানে বসে কফি খেয়ে তারপর…” কথাটা শেষ করতে পারলোনা হেমিংওয়ে, বিপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিলো, দুইবার উল্টে গাড়িটা একটা বড় গাছে গিয়ে আটকালো। যেন মুহূর্তেই সব তচনচ হয়ে গেছে। পেছনের সিট থেকে কোনোভাবে বের হয়ে আসলো ক্রিস্টিন আর রয়। তাদের তেমন একটা আঘাত লাগেনি। রয়ের বা চোখের উপরে দিকটায় কাচ লেগে রক্ত বের হচ্ছে। ক্রিস্টিনের দুই পায়ে খানিকটা চোট লেগেছে। ভাগ্য কিছুটা ভালো, গাড়িটা গাছে আঁটকে ছিলো। না হয়… আচ্ছা, হেমিংওয়ে কই? মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে সামনের দরজা খুলে হেমিংওয়েকে টেনে বের করে তারা দুজন। সারা মুখে রক্ত। চেহারা দেখে বুঝার অবস্থা নেই। পেটে দুটো ভাঙ্গা কাচের টুকরো ঢুকে পড়েছে। রয় বুঝতে পারছেনা কি করবে। অজানা অচেনা চারপাশ। এর মধ্যে খবর পেয়ে হাইওয়ে পুলিশ চলে আসে। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের এক হাসপাতালে।

হাসপাতালেই সে রাত পার হলো। রয় আর ক্রিস্টিন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠলো বটে, তবে ঘুমাতে পারলোনা চিন্তায়। হেমিংওয়েকে নিয়ে যাওয়া হইয়েছিলো আই.সি.ইউ-তে। পরদিন আসলো খবরটা – বাঁচানো যায়নি হেমিংওয়েকে। শুনে যেন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা হেমিংওয়ে আর নেই। কি ভেবেছে, আর কি হচ্ছে এসব?

হাসপাতাল থেকে রিলিজ করতে হলে কিছু কাগজপত্র লাগবে। ক্রিস্টিন হেমিংওয়ে’র ব্যাগ চেক করে। খুজতে গিয়ে ব্যাগে নীল খামের ভেতর একটা চিঠি খুঁজে পায়। কিন্তু চিঠি পড়ার সময় এখন নয়। যে কাগজটা খুঁজছিল সেটা নিয়ে হাসপাতালের রেসিপশনে গেলো। প্রয়োজনীয় ফরমালিটি সেরে হেমিংওয়ের লাশ নিয়ে ফিরছে ক্রিস্টিন আর রয়। তাদের চোখে মুখে অন্ধকার। কারও মুখে একটা শব্দ নেই। কতো স্মৃতি, কতো পরিকল্পনা মুহূর্তে শেষ হয়ে গেলো। মনে পড়তেই দু চোখে শুধু পানি ঝরছে শুধু।  

ক্রিস্টিনের মনে পড়ে হেমিংওয়ের ব্যাগে থাকা চিঠিটার কথা। খুঁজে নিয়ে নীল খামের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে সে। খুব যত্ন করে হেমিংওয়ের নিজ হাতে লেখা চিঠি। তাতে লেখা –

//

প্রিয় ক্রিস্টিন,

আমার দু চোখের আলো, আমার রাজ্যের সব মুগ্ধতা।

এই প্রানের বিনিময়ে হলেও আমি তোমাকে চাই।

তুমি কি আমার হবে?   

ইতি,

হেমিংওয়ে।

//