প্রিয় অভিভাবক সমীপে…

Yusuf's Diary

প্রিয় অভিভাবক সমীপে…

এই লেখাটি যখন লেখার পরিকল্পনা করছি, এস এস সি, সুইসাইড – এই দুটি কিওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে আমি অসংখ্য খবরের লিংক পেয়েছি। অতী পুরনো থেকে অতী সাম্প্রতিক খবরের ছড়াছড়ি এ নিয়ে। প্রতিবার একটা করে পাবলিক পরিক্ষার ফলাফল বের হয়। আর তার সাথে সাথে প্রকাশ হতে থাকে বাচ্চাদের আত্নহত্যার খবর।

সপ্রতি এস এস সি পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পর একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাওর হয়ে উঠে। ভিডিওতে দেখা যায় কয়েকজন অভিভাবক নাচানাচি করছেন। একজন সাংবাদিক উনাদের কাছে যান এবং এই নাচানাচির কারন জানতে চান। উত্তরে তারা জানান তাদের মেয়েরা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। তাই তাদের এই উদযাপন। সবাই মজা করে এই ভিডিও শেয়ার করছেন, আর হাসাহাসি করছেন। বাবামা’রা সন্তানের সাফল্যে আনন্দিত হতেই পারেন, স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভাবছি তার উল্টোটা। এতো এতো গোল্ডেন এ প্লাসের ভেতরে নেচে নেচে উদাযাপন করা অভিভাবকের কেউ একজনের সন্তানের ফলাফল এতোটুকু খারাপ হলে তার অবস্থা কি হতো ভাবুন তো? পুরো পজিটিভ এনার্জিটুকু একটা বাচ্চার উপর নেগেটিভ ফোর্স হিসেবে চাপতো! ভাবা যায়? তার মনে হবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধটা সে করে ফেলেছে। তাই গোটা দুনিয়া তার বিপরীতে। আর এই মুহূর্তে বাচ্চাটা যদি আবেগের বশীভূত হয়ে সুইসাইড করে ফেলে তাহলে কিন্তু বাবামা’রা ঠিকই বলবেন – কেনো এমন করলি আমার কলিজা? ফলাফল  খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে? কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফলাফল  খারাপ করলে ঠিকই ওই ভয়ংকর খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হতো।

ছোট ছোট বাচ্চা, তাদের এমন আর কি কষ্ট যে নিজেকে একেবারে শেষ করে দিতে পারে? কিছুর কথা না ভেবেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো? আপনার মনে এমন হাজারো প্রশ্ন আসতেই পারে। আসলে আমরা সবাই এখন ভয়ংকর এক ইঁদুর দৌঁড় প্রতিযোগিতায় আছি। যে প্রতিযোগীতার কোনো শেষ নেই।  এই প্রতিযোগিতা আমাদের হতাশা ও বিষণ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দিচ্ছে। পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানুষকে আরও চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বাবামা’রা যুক্তি দেখাতে পারেন – কোনো বাবামা তো আর সন্তানের অমঙ্গল চায় না। চায় না সন্তানেরা খারাপ থাকুক, কষ্ট পাক। কিন্তু এতো পরিশ্রমের পরও যদি ভালো ফলাফল  না করে, সমাজে মুখ দেখাবো কি করে? তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনারাই সমাজ বানিয়েছেন। একজন একজন করে গোটা সমাজকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।

আপনার আচরন তারা দেখে শেখে। আপনাদের কাছ থেকেই তারা দেখে শিখে। আপনাকে দেখে তারা বুঝে এ প্লাস-ই সব। তারা দেখে এ প্লাস না পাওয়াদের কিভাবে দেখা হয়। বাচ্চাদের নিষ্পাপ মনটাকে অভিভাবকেরাই কালো করে তুলেন। তারা শিখিয়ে দেন পাশের জনকে নোট না দেয়ার কথা। তারাই বাচ্চাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেন যেকোনোভাবে এ প্লাসটা পেতে হবে। না হলে ষোলোআনাই বৃথা। আপনি যদি অভিভাবক হোন আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। প্রশ্নটা থ্রি ইডীয়টস থেকে নেয়া। আপনি প্রতিদিন কোন টেস্টে কতো মার্কস পেয়েছ সেটা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কখনোই কি জিজ্ঞেস করেছে সে তার বন্ধুকে সাহায্য করেছে কিনা? না, করেন নি। তাহলে তো সবকিছুর উর্ধে এ প্লাস-কে স্থান দেয়াটাই স্বাভাবিক।

স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম সেই ১৭ শতকে তার ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষ কখনোই তার জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জীবনটা তার কাছে মূল্যবান থাকে।’ বিষণ্ণতা থেকে আবেগ তৈরি হয়, আশা চলে যায়, অন্য কোনো উপায় খুঁজে পায় না মানুষ, একমাত্র উপায় হয় তখন নিজের জীবন নিয়ে নেওয়া।

ও কখনো স্বার্থপরের মতো মরে যাওয়ার কথা ভাবেনি, ভেবেছে আমাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য। আমরা ওকে বুঝাতে পারিনি যে তুমি একা নও। ফলাফল  যখন খারাপ হয়, তখন সে ভাবে তার আর কোনো উপায় নেই। কারন আপনি তার মাথায় ঢুকিয়েছেন যে, এ প্লাস সবকিছুর উর্ধে। এমনিতেই অপরিণত বয়স, তার উপর এতোকিছু তার মাথায় ধরে না। সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়।

পড়ালেখা, ভালো ফলাফল অবশ্যই খুবই গুরুত্বপুর্ন। তবে এতোটা গুরুত্বপুর্ন নয় যতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবলে সে এর বিনিময়ে নিজের জীবনকে ছুড়ে ফেলার কথা ভাববে। ভাববে গোটা দুনিয়ার সবাই তার বিপরীতে। এ প্লাস কেন্দ্রিক এই দুনিয়ায় তার আর কোনো স্থান নেই। চলুন তাদের বুঝাই, এ প্লাস পাওয়া গুরুত্বপুর্ন, তবে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো কিংবা ভালো মানুষ হওয়া কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাবধান, খুব স্বার্থপর একটা প্রজন্ম গড়ে তুলছি আমরা। একজন অভিভাবক হিসেবে এর দায় আর ফলাফল কোনোটাই এড়াতে পারেন না আপনি।  

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.
Back To Top