ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা; একটি প্রস্তাবনা

Yusuf's Diary

ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা; একটি প্রস্তাবনা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নানান সময় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক বিকাশের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন শুধুমাত্র পড়াশুনায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে সন্তানদের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা বাড়াতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাটাই এমনভাবে সাজানো, যেখানে একাডেমিকের বাইরে চিন্তা করারই সুযোগ নেই। শিক্ষা নামের এই ইঁদুর-দৌড়ে এক মুহুর্ত থেমে থাকলেই যে হাজার জনের পেছনে পড়ে যেতে হবে।

সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ক্রমাগত নানান পরিবর্তন নিয়ে আসছেন। নিচ্ছেন নানান উদ্যোগ। পাঠ্যবইয়ে মূল আলোচনার পাশাপাশি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন বিষয় যেমন সংযোজন-বিয়োজন করছেন, পাশপাশি বইয়ের যে কনটেন্ট, তার মান উন্নয়নে কাজ করছেন। কিন্তু ঠিকই গোড়ার গলদটা যেনো থেকেই যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তা কার্যকরী হচ্ছেনা।   

এমন অবস্থা থেকে উত্তরনের সহজ উপায় হতে পারে সকল বোর্ড পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা। (সহ-শিক্ষা কার্যক্রম বলতে সেসব কাজকে বুঝানো হচ্ছে যা একজন ছাত্র বা ছাত্রি পড়াশুনার পাশাপাশি স্বেচ্ছায় নিজের অন্তর্নিহিত প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে হিসেবে বেছে নেয়। এই মাধ্যম হতে পারে লেখালেখি, গান, অভিনয়, সামাজিক কাজ এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের সন্তানের বাবাকে সাহায্য করার কাজটি) কার্যতই এই সহ-শিক্ষাধর্মী কাজগুলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।  

শুরুটা করা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে। শিক্ষার সর্বোচ্চস্তরে এর প্রয়োগ শুরু হলে গোটা ব্যবস্থায় একধরণের ‘রিপল ইফেক্ট’ তৈরি হবে যা ক্রমান্বয়ে শিক্ষার সকল স্তরে পৌঁছে যাবে। এখন দেখা যাক এর মূল্যায়ন কেন জরুরীঃ  

  • যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে যারা ইতিমধ্যে সহশিক্ষার সাথে যুক্ত তারা যেমন তাদের কাজের জন্য মূল্যায়িত হবেন, অন্যদিকে যারা যুক্ত নয় তারাও যুক্ত হতে উৎসাহিত হবেন।   
  • সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন জীবনদক্ষতা যেমন দলগত কাজ, যোগাযোগ, মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা কৌশলীচিন্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যা তার ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং চাকুরিজীবনের নানান ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।  
  • কোন বাবামা’ই চাননা তাদের সন্তান সারাদিন পড়াশুনার চাপের মধ্যে থাকুক। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হলে একদিকে যেমন সন্তানেরা দম ফেলার সুযোগ পাবেন, অন্যদিকে বাবামারাও একটু স্বস্তিতে থাকবেন।
  • আমাদের তরুণদের মাঝে মাদক গ্রহণের প্রবনতা ক্রমেই বাড়ছে। যদি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্যসকল বোর্ড পরীক্ষায় আবশ্যিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে সৃজনশীল কাজে অন্তর্ভুক্তি তাদের মাদকের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেবে।

আমেরিকা তথা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের কীভাবে নির্বাচন করা হয় তা নিয়ে পড়ছিলাম। যেকোন দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটা লক্ষ্য থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অংশীজনেরা সম্মিলিতভাবে শিক্ষার সে কাঙ্ক্ষিত সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জন করতে কাজ করে। এই লক্ষ্য অর্জন করাটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৃষ্টিতে একেকটা একটা পাহাড় জয়ের মতো।

কোন দল যখন পাহাড় জয় করতে যান তখন দলের সব সদস্য শুধুমাত্র একটা বিষয়ে পারদর্শী হলে আগানো যাবেনা। যেহেতু এটা একটা কঠিন কাজ, তাই বিভিন্ন সময় বিভন্ন রকম বাঁধা আসতে পারে। একটা পর্যায়ে কোন কারণে দলের মনোবল ভেঙ্গে গেলে প্রয়োজন এমন কারও যিনি দলকে উজ্জীবিত করতে পারবেন। আবার যদি হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দরকার এমন কেউ যিনি ফার্স্টএইডে দক্ষ।

অনুরূপ, দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অথবা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থী। যদি শুধুমাত্র জিপিএ বা ভর্তিপরিক্ষার নম্বরের মাপকাঠিতেই সবাইকে মাপার চেষ্টা করা হয় তাহলে তারা একদিকে যেমন ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন না, অন্যদিকে মেধাবীরাও যথাযত মূল্যায়িত হবেন না।

কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরিক্ষায় চলমান যে একমুখী নির্বাচন প্রক্রিয়া আছে তা থেকে সরে আসা জরুরী। প্রয়োজনে কয়েকস্তরের মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। চলমান পদ্ধতিতে জিপিএ, লিখিত ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষার উপর শতভাগ নম্বর নির্ভর করে। তার পরিবর্তে একডেমিক ফলাফলের উপর ৬৫% নম্বর বরাদ্ধ রাখা যেতে পারে। বাকি ৩৫% বিবেচনা হতে পারে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের উপর। নানান উপায়ে এই সহশিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা যায় যা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সমাদ্রিত। যেমনঃ  

  • সহ-শিক্ষার ধরনের উপর ভিত্তি করে ছাত্রছাত্রীদের অর্জিত জ্ঞানের গভীরতা বুঝার লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক ‘এনালিটিক্যাল রচনা’ লিখতে দেয়া যেতে পারে।
  • ভাইভা ও প্রায়োগিক পরীক্ষায় জোর দেয়া যেতে পারে।
  • সংশ্লিষ্ট সহশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা রাখেন এমন কারও রেকমেন্ডেশন লেটার চাওয়া যেতে পারে।  

এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারা। রচনা, রেকমেন্ডেশন লেটার বা ভাইভা’র মতো বিমূর্ত মাধ্যম ব্যবহার করে একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার জন্য যাচাইকারীর যথেষ্ট অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। তাছাড়াও সিদ্ধান্তকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার সুযোগও তৈরি হয়। তবে যথাযত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে সামগ্রিক ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে পারে তা শ্রমকে ছাড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।  

—–

ইউসুফ মুন্না, কিশোরভিত্তিক সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম Reflective Teens এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে অধ্যয়নরত আছেন।     

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.
Back To Top