পাঁচমাস হতে চললো লকডাউনের। দোকানপাট, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – সবকিছু বন্ধ। কিন্তু এভাবে তো বেশীদিন চলবে না। সরকার সিদ্ধান্ত নিলো দোকানপাট খুলে দেয়া হবে সীমিত পরিসরে। কিন্তু খুলবেনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে ক্লাস হবে অনলাইনে। এটা সুচিন্তা। সরকারকে ধন্যবাদ। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় এক নতুন বৈষম্যের। দ্যা ডিজিটাল ডিভাইড। আমি নিশ্চিত নই ঠিক কি চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত আসলো। সরকার ভাবলো, ছাত্রদের তো আর বসিয়ে রাখা যায়না। দেশ ডিজিটাল। তাই সবার ঘরে ঘরে ইন্টারনেট আছে। ওদিকে পার ক্যাপিটা ইনকাম তরতর করে বাড়ছে। মানে লোকজনের হাতে টাকাও আছে। চাইলেই ভালো ডিভাইস কিনতে পারে। ব্যাস! সরকারের দৃষ্টিতে এটা একেবারে ঠিক, কিন্তু বাস্তবতা থেকে সেটা বেশ খানিকটা দূরে বলে মনে হয়।
বেশকিছু বাঁধা আছে আমাদের। অবকাঠামোর কথা যদি বলি, বিভাগীয় শহর আর জেলা সদর বাদে, সারা দেশের ইন্টারনেট পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল। ফলশ্রুতিতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে যে মানের ইন্টারনেট সংযোগ থাকা প্রয়োজন সেটা পাওয়া যায়না। উপরন্তু নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট তো আছেই। অন্যদিকে অনেকেরই যথোপযুক্ত ডিভাইস নেই। তাছাড়াও অনলাইনে শিখন-পঠন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক বা ছাত্র কেউই পূর্বে অভ্যস্ত বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। এতো সব সমস্যাকে বহুগুণে প্রকট করেছে বর্তমান প্রেক্ষাপট। করোনাকালীন এই সময়ে এমনিতেই অর্থনীতির সূচক নিম্নমুখী। মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে এসেছে বন্যা। বর্তমানে দেশের অর্ধেকের বেশী অঞ্চল পানির নীচে। পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ যে, অল্পদিনে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার পথে। এমনিতেই কাজ নেই। তার উপর এবারের বন্যা অনেক সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী নিম্ন মধ্যভিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। হোক সেটা বন্যা, অথবা মহামারী, তাদের উপর ঝাপটা লাগে সবচেয়ে বেশী। সত্যিই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অগ্রসরমান। কিন্তু এই সময়কে অন্য স্বাভাবিক সময়ের সাথে তুলনা করলে সেটা বড় ভূল হবে। যেখানে তিনবেলা ভাত নিশ্চিত করাই দায় হয়ে ঠেকেছে, সেখানে ভালো একটা ডিভাইসে নিয়মিত ডাটা প্যাক কিনে ক্লাস করাটা বোধহয় একটু কঠিনই। তার উপর ইন্টারনেটের মান এবং বিদ্যুতের স্থিতিশিলতা তো নিয়ন্ত্রনের বাইরেই থেকে যায়।
তার মানে এই নয় যে অনলাইনে ক্লাস করা যাবেনা। অবশ্যই যাবে। সেজন্য ছাত্রদের আগ্রহ যেমন দরকার, তেমনই দরকার সরকারের প্রচেষ্টা। বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় আনা যেতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজের ব্যবস্থা করতে পারে। একইভাবে ডিভাইস কেনার জন্য সরকার বিনাসূদে লোনের ব্যবস্থা করতে পারে। প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকির ব্যবস্থাও করতে পারে। তার পাশাপাশি শিক্ষকেরা শুধু ক্লাস কেন্দ্রিক পাঠদান প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে এসাইনমেন্ট, দলগত কাজ এর মতো বিকল্প প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে পারেন।
অনেকেরই ভালো ডিভাইস আছে, আছে নিয়মিত ইন্টারনেট কেনার সামর্থ্য। একইভাবে অনেকের নেইও। অনলাইন ক্লাস না হলে, সবসুবিধা থাকা সত্ত্বেও কিছু ছাত্রছাত্রী পিছিয়ে পড়বে। বিপরীতে, হলেও পিছিয়ে পড়বে অনেকেই। কি উপায় আমাদের? সিদ্ধান্ত যেটাই হোক, গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মানবিকতা যাতে হারিয়ে না যায়।