জীবন থেকে নাই হয়ে যাওয়া একটি দিন

Yusuf's DiaryLeave a Comment on জীবন থেকে নাই হয়ে যাওয়া একটি দিন

জীবন থেকে নাই হয়ে যাওয়া একটি দিন

পহেলা মার্চ, ২০১৯। শুক্রবার রাত ১১টা। হানিফ পরিবহনের বাসে চেপে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। যাচ্ছি ‘BRAC Frugal Innovation Forum – 2019’ এ। বাসা থেকে নাফিস, অপু আর রুবেল গিয়েছিলো আমাকে বাসে তুলে দিতে। অটো থেকে নেমে একসাথে চা-কলা খেয়েছি, তারপর বাসে উঠেছিলাম। কাউন্টারে ‘বাম পাশে, মাঝখানের কোনো সিট’ খালি আছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। না পেয়ে অগত্যা ডান পাশের ‘জিথ্রি’ তেই বসতে হলো।

বাস চলছে…চলছে…। পাশের সিটে কেউ নেই। তাই ব্যাগটা খালি সিটেই রাখলাম। যশোরের মনিহার সিনেমা হলের পাশে হানিফের কাউন্টার। রাতে ভাতটাত খাওয়া হয়নি। কোথাও যাওয়ার আগে কিছু খেতে আমার ভালো লাগে না। অবশ্য সে রাতে মেসে বুয়াও আসেননি। ১৫ মিনিটের বিরতিতে একটা চা, একটা কলা খেয়ে নিলাম। একটা পানিও কিনে নিলাম।

বাস আবার চলা শুরু করলো। এখনো পাশের সিট ফাঁকা। বাস পউছালো দৌলতদিয়ার ঘাটে। এবার ফেরির অপেক্ষা। প্রথমে একঘাটে গিয়ে ফেরি না পেয়ে অন্য ঘাটের দিকে চলছে গাড়ি। পথিমধ্যে দুই ভদ্রলোক বাসে উঠলেন। একজন লোক বসতে চাইলেন এবং বসলেন আমার পাশের সিটে। অন্যজন আমার ঠিক পেছনেরটায়। মাঝে অনেক আগে কন্ডাক্টর এসে একবার জিজ্ঞেস করে গিয়েছিলেন কোথায় নামবো। আমি বলেছি গাবতলী। সেটা অবশ্য বাসে উঠার একটু পর পরই। যাহোক…

বাস ফেরিতে উঠলো। ফেরি চলছে। আমি ব্যাগ বাসে রেখেই বাস থেকে ফেরিতে নামলাম। টয়লেটগুলোতে দেখি লাইন পড়েছে। আমি আশাহত হয়ে পাশের ছোট দোকানটায় বসে আছি। দশটাকার ঝালমুড়ি আর একটা লাল চা খেতে খেতে টয়লেটের লাইনও শেষ। শৌচকার্য সেরে আবার বাসে উঠে পড়লাম। পাশের ভদ্রলোক দেখতে খুব হাসিখুশি চেহারার। একদম আমার মতো স্মাইলি ফেস। কাপড়চোপড়ে এতোটাই ভদ্র যে শুধু টাই পড়াটাই বাকি।

ফেরি পার হয়ে বাস কিছু দূর গেলো। পাশে বসা ভদ্রলোক আমাকে অর্ধেক প্যাকেটের একটা এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট থেকে বিস্কুট অফার করলেন। আমি বললাম ধন্যবাদ ভাই, খাবো না। উনি বললেন, না ভাই খান। সমস্যা নাই। আমি একটা বিস্কুট খেলাম। পরে ভদ্রতার সহিত জোর করে আরেকটা বিস্কুট খাওয়ালেন। ওই প্যাকেট থেকে উনিও বিস্কুট খাচ্ছিলেন। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই খেয়েছি। আমি তখন আমার বন্ধুর সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করছিলাম। জিজ্ঞেস করলো ‘কতোদূর গেলি?’ আমি বললাম পদ্মা পার হলাম মাত্র। একটু পর এবার অফার করলেন ফান্টা। সেটাও তিনি যথারীতি ভদ্রতার সহিত জোর করে খাওয়ালেন। আমি প্রথমে এক ঢোক গিলেছিলাম। পরে আরেক ঢোক। এই আরকি। ওই লোকের সাথে তেমন একটা কথা হয়নি গোটা জার্নিতে।

রাত মোটামুটি সাড়ে তিনটা। চোখে ঘুম আচ করা শুরু করেছি। রাত যেহেতু সাড়ে তিনটা, ঘুম আসারই কথা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়ালই করিনি।

মাঝে একদিন জীবন থেকে নাই হয়ে গেলো। শুক্রবার রাত (আসলে রাত ১২টার পর তো শনিবারই হয়ে গিয়েছিলো।) গোটা শনিবার অজ্ঞান থাকার পর, রবিবার সকাল নাগাদ চোখ খুলে নিজেকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতভাবে আবিষ্কার করলাম ঢাকা মেডিকেলের ব্যাডে। ক্যাথেটার আর ডান হাতে ক্যানুলা লাগানো। চোখ খুলতেই প্রথম দেখলাম বাবাকে। কিরে? কি হলো? আমি কোথায়? এ জায়গাটায় বাংলা সিনেমার কাহিনী মনে হলেও, বিশ্বাস করুন, তাই ঘটেছিলো আমার সাথে। আগের গোটা দিনে কিভাবে কখন কি ঘটেছিলো সেটা সম্পর্কে কিছুই মনে করতে পারছিলামনা আমি। হঠাত এমন অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে খুবই অস্বঃস্থি বোধ করছিলাম। আবার বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছি বা ঘুমিয়েছি বেশ কয়েক ঘন্টার জন্যে। এবার জেগে দেখি ক্যাথেটারও নেই, ক্যানুলাও নেই। বাবা পাশে বসে আছেন আর কপালে হাত বুলাচ্ছেন।

পকেটে থাকা হাজার পাঁচেক টাকা, ব্যাগে থাকা দুই দিনের কাপড়চোপড়, ল্যাপটপ, দুটো বই (এর মধ্যে একটা হলো নিয়াজ আহমেদ এর ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ যেটার জন্য অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। বেশ কিছুদূর পড়েছি। ভেবেছিলাম যাত্রা পথ আর গন্তব্য মিলিয়ে শেষ করে ফেলবো। সেটা আর হলো কিভাবে!), মোবাইল এর সাথে দুটো পেনড্রাইভ, ব্যাবহৃত ব্রাশ, চার্জার, হেডফোন এবং ব্যাবহৃত জাঙ্গিয়াও খোয়ালাম। তাও ভালো, জীবনটাতো খোয়ায়ইনি। তবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকেই অনুভব করেছি।

এবার আসা যাক নাই হয়ে যাওয়া দিনটাতে। প্রথমেই বলে রাখি এর সবটুকুই শোনা। সেই ঘুমের ঘোরেই তো অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এইদিকে ভদ্রলোক শালা তার পার্টনার সহ সব লুট করে নিয়ে কোথায় নেমে গেলো কে জানে! বাস গাবতলী ছাড়িয়ে কল্যাণপুর চলে এলো। লাস্ট স্টপেজ। কন্ডাক্টর আমাকে কিঞ্চিৎ চেতন অবস্থায় কাউন্টারে নামালেন। আমাকে ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করার পর আমি নাকি আমার বোনের নাম্বার দিয়েছি (যদিও তার কিছুই আসলেই আমি মনে করতে পারছি না)। আপু হতে দুলাভাইয়ের মাধ্যমে উনার এক ছোটভাই আমাকে কাউন্টার থেকে আমাকে নিয়ে যায় পাশের এক ক্লিনিকে। সেখানে আমার প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। তারপর ঢাকা মেডিকেলে। ততক্ষণে আব্বু উড়ে এসেছেন কক্সবাজার থেকে। ঢাকায় থাকা আমার অনেক বন্ধু, বিশেষ করে সুদীপ্ত, হাবিব, সাদমান, ইয়ার মোহাম্মদ, ঢামেকে পড়ুয়া বন্ধু হাসনাত, আমার তালতো ভাই তথা ফিউচার স্টার্টআপের রুহুল কাদের ভাই সহ অনেক আত্নীয় এসেছেন দেখতে। সবার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা।

যাহোক, অসুস্থতার কারনে একদিন মিস গেলেও কোনভাবে ম্যানেজ করে দ্বিতীয় দিন জয়েন করলাম ব্রাক সিডিএমে তে ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরামে’। সেখানে আমার রুমমেট হলো লাবিব। লাবিব তাজওয়ার রহমান। স্ট্যানফোর্ডে পড়ছেন। বন্ধুবর লাবিব আমেরিকা থেকে বার্সেলোনা হয়ে বাংলাদেশে আসার পথে সেও লাগেজটা হারিয়ে এসেছে বার্সেলোনা এয়ারপোর্টে। এই হলো সম্পূর্ণ ঘটনা।

ওষুধ খাচ্ছি। ঠিক হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। তবে যতদিন এই পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকবো, তার চেয়ে একদিনের কম স্মৃতি থাকবে আমার।

 

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top