অন আ ব্রেক

ঘড়িতে যখন সকাল সাড়ে ছয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে একটু হকচকিয়ে গেলো রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “কি খবর? কেমন যাচ্ছে সবকিছু?” শীতের সকাল। অন্যদিন হলে শীতকে জয় করে গায়ে জড়ানো লেপ ছেড়ে হিমশীতল পানিতে মুখহাত ধুতেই পাক্কা একঘন্টা লাগিয়ে দেয়ার কথা। আজকে তার ব্যতিক্রম। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রিশান। জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নন্দনকাননের যে বাড়িটায় থাকে, সেখান থেকে জানালা দিয়ে ডিসি হিলের খুব সুন্দর একটা অংশ দেখা যায়। কৃষ্ণচূড়ার গাছটা লালে-লাল হয়ে আছে। কোথা থেকে একটা শালিক পাখি এসে বসেছে। এই বাসাটায় রিশান আছে গতো তিন বছর ধরে। প্রতিদিন কাঁক দেখা যায়, চড়ুই দেখা যায়, মাঝে মাঝে ময়নাও দেখা যায়। কিন্তু শালিক কখনো চোখে পড়েনি তার। পাখিটার দিকে গভীর মনোযোগে তাকাতেই একসাথে অনেকগুলো স্মৃতি ধরা দিলো। যেন শালিকটা দুইপাখা বোঝাই করে এনেছে সেগুলো। যেই স্মৃতি রোমন্থনে ডুব দিবে, অমনিতে বিকট শব্দে তার মনোযোগ ভিন্নদিকে চলে গেলো। মোড়ের ট্রান্সফরমারটা ফুটে গেছে। পরক্ষনে অনেকগুলো কাঁককে দেখা গেলো কাঁ-কাঁ করতে ঝাক বেঁধে ওদিকে যেতে। তাদের দলের কোন কাঁক হয়তো মারা গেছে ঐ ট্রান্সফরমারে।

সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরে ভার্সিটিতে যাবে রিশান। এরই মধ্যে বিশ মিনিট চলে গেছে। আপাতত স্মৃতিচারনের সময় নেই। কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে শীতের কাপড়টা গায়ে চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। একটা রিকশা নিয়ে পৌঁছে যায় ষ্টেশনে। এখন আর আগের মতো ফ্যামিলি বগিতে বসার তাড়া নেই। শাটলে পলিটিক্স বন্ধ করে দেয়ায় রিশানের ভালোই হয়েছে। কোন একটাতে উঠে গেলেই হলো, সোজা ভার্সিটি পৌঁছে যাওয়া যায়। একটু পর শাটল চলতে শুরু করলো। জানালার পাশের একটা সিটে রিশান বসে আছে। ব্যাগ থেকে সমরেশ মজুমদারের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ বের করেছে। বই খুলে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ার আগ্রহ নেই। তাঁর মনোযোগের পুরোটা জুড়ে তানিশার ঐ টেক্সটটা। আবার সে ভাবনার রাজ্যে ডুব দিলো…

তানিশার সাথে তাঁর দেখা হয় ভার্সিটি কোচিং এর সময়। প্রথমে ক’দিন চকবাজারে করলেও এতো লোকের আনাগোনা ভালো না লাগায় জিইসিতে চলে আসে রিশান। সেখানেই তাদের দেখা। দুজনই পড়াশুনায় ভালো। কোচিং এর মডেল টেস্টে প্রথম দিকে থাকতো তারা। একজন আরেকজন থেকে নোট ধার নিতো, পড়া বুঝিয়ে নিতো। আবার কোনদিন দুজনে বই নিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। কাজের-অকাজের কথা, নিয়মিত দেখা হওয়া, একই ভালো লাগার বিষয় – একটা ফ্রেন্ডশিপকে এগিয়ে নেয়ার উপঢৌকন হিসেবে যা দরকার, তার সব ছিলো তাদের মধ্যে। ঐ উঠতি বয়সে যেমনটা হয়, কোচিং এর এক ছেলেকে ভালো লাগা শুরু হয় তানিশার। ছেলে মানে, কোচিং এ ক্লাস নেন। সাধারণ জ্ঞানটা ভালোই পড়ায়। ভালো লাগার ব্যাপারটা রিশানকে জানায় সবার আগে। প্রেমট্রেম নিয়ে রিশানের খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। রিশান টুকটাক পরামর্শ দিতো আর সুযোগ বুঝে মজা করতো, খেপাতো। কিন্তু তানিশা’র আগ্রহের তীব্রতা দেখে তার অস্বস্তি শুরু হয়।

অজান্তে বন্ধুর চেয়ে বিশেষ কোন জায়গা দিয়েছিলো তানিশাকে? নাকি উঠতি বয়সের মায়া? এসব প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খায়। এদিকে তানিশাও অবস্থা বুঝে দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেই যে দূরে চলে যাওয়া, আর কাছে আসা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি। অবশ্য, যোগাযোগ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেটা বললে খানিকটা ভুল হবে। রিশান টুকটাক খবরাখবর রাখতো। জেনেছিলো, ছেলেটার সাথে নাকি একসময় সত্যি সত্যি সম্পর্কে জড়ায় তানিশা। তারপর আর কি হলো তার ধারণা নেই। শাটল ভার্সিটির ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে। রিশান গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত সকালের নাস্তাটা সেরে ক্লাস ধরতে গেলো।

সারাদিন ঝামেলার মধ্যে টেক্সটের উত্তর দিতে ভুলে গেছে রিশান। খেয়ালই ছিলনা। সেদিন সন্ধায় বাসায় ফিরে ফোন হাতে নিলো উত্তর দিবে ভেবে। আরেকটা টেক্সট এসেছে তানিশার নাম্বার থেকে। “বুঝতে পেরেছি, বহুদিনের চাপা ক্ষোভের ভার উপড়ে উত্তর দেয়ার আগ্রহ পাওনি হয়তো। কাল বিকেল পাঁচটায়, রিওতে চলে এসো”। রিশান এবার অনেকটা দায়সারা উত্তর দিলো – “আচ্ছা”।  

তানিশা আগে এসেছে। দরজায় অপেক্ষা করছে রিশানের জন্য। রিকশা থেকে নামতেই যখন তানিশাকে চোখে পড়লো। দুই বছরে অনেক বদলেছে সে, কিন্তু একেবারে না চেনার মতো নয়। এক চিলতে মুচকি হাসি আর ভাব বিনিময়ের পর দুজনে উপরে উঠে গেলো। ক্যাফের দক্ষিন পাশটা একটু নিরব। সেখানের দুটো চেয়ারে বসে আলাপ শুরু হলো তাদের। নিজের জন্য একটা লাটে অর্ডার করেছে। রিশান কিছু খেতে চায়নি। পরে অনেকটা জোরাজোরির পর একটা এস্প্রেসো দিতে বলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কতোকিছু উঠে আসে সেদিন। পরিবার, পড়াশুনা, ভবিষ্যৎ ভাবনা সহ কতো কিছু। কিন্তু একটা বিষয় বেশ সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেলো তানিশা – ব্যক্তিগত জীবন। রিশানও বুঝতে পেরে খুব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হয়তো ভালো যাচ্ছে না। বুঝতে অসুবিধে হলো না, কৈশোরের অস্থিরতা আর নেই। শান্ত আর ধিরস্থির আর সবকিছুতে পরিপক্ষতার ছাপ। এতোদিন পরে দেখা, কিন্তু আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই কথায়। একদম ভার্সিটি কোচিংয়ের দিনগুলোর মতো। পারলে খানিকটা বেশী বলা চলে। অনেকদিন পর দেখা বলে এমনটা হতে পারে। কে জানে?

ছেলেমানুষী স্রোত নাকি বর্ষায় তীব্র হয়, চৈত্রে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু নদীতে বোধ হয় বর্ষা ফিরে এসেছে। স্রোত তার তীব্রতা ফিরে পেয়েছে ধীরে। রিশান আর তানিশা ঘন্টার পর ঘন্টা বাতিঘরে বই বাছাই করে কাটিয়েছে, রিকশায় সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে বা কোনদিন ভোরে দুজনে সিআরবি’তে চরকির মতো ঘুরেছে – এভাবে নানান ছলে দুজনের কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে, ভাবের বিনিময় হয়েছে, আর সম্পর্কটা পরিপক্ষ হয়েছে।

কোন এক সকাল। ঘড়িতে যখন সকাল নয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। রিও’তে বিকাল চারটা”। শনিবার, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এদিকে তানিশার সাথে দেখা হবে বিকালে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠার তাড়া নেই রিশানের। বিছানায় শুয়েই জানালার বাইরেরটা দেখা যায়। হঠাত মনে হলো, আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। কি যেন নেই-নেই ভাব। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো, ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো রিশান। কৃষ্ণচূড়া গাছ, টকটকে লাল ফুল, আর পরিচিত পাখিগুলো – সবই তো আছে। তবুও এমন মনে হচ্ছে কেন? সারাদিনটা তার কেমন এক বিষন্নতায় কাটলো। বিকালে বেরিয়েছে। রিওতে পৌঁছে দেখে বসে আছে তানিশা। নাহ, শুধু তানিশা না… সাথে আরেকজন। আরেকটা ছেলে। দূর থেকে দেখে মনে হলো, খুব পরিচিত চেহারা। হ্যাঁ, ওই যে… কোচিং এ যে ছেলেটা ক্লাস নিতো। রিশান বুঝে উঠতে পারছেনা। যেন হঠাত তার মাথায় আঁকাশ ভেঙ্গে পড়লো। দূর থেকে দেখে আর সামনে পা বাড়ায়নি। নীচে নেমে ফোন দেয় তানিশাকে।কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, এখনও আসতে পারলেনা না? তানিশা বলে উঠে।

আগে বলো ঐ লোকটা কে।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো। তার জন্যই তো আজকে দেখা করতে চাইলাম!

না, যা বলার এখানেই বলো।

তানিশা একটু থামলো। তারপর নিচু গলায় বললো…সজীব।

তা আমি চিনেছি। কিন্তু সে এখানে কি করছে?

ফোন কেটে দিলো তানিশা। রিশানও চলে গেলো। একটা রিকশা ভাড়া করে চললো বাসার দিকে। আরেকটা টেক্সট এসেছে, তানিশার কাছ থেকে। তানিশা লিখেছে – “We were on a break”

আমার লেখালেখি, আমার বই পড়া

পিয়ানো সুর আমার কাছে খুব মোহনীয় মনে হয়। লিখতে বসার আগে ফোনে পিয়ানোর আলতো সুর বাজিয়ে দিই। বেশ ভালোই লাগে। মনে হয় লিখায় গতি পেলো। অনেকদিন ধরে লিখবো লিখবো ভেবে কীবোর্ড সামনে নিয়ে বসেছি। উঁহু, কোনভাবেই লিখা হয়ে উঠছেনা। রাইটার্স ব্লক। হাজারো শব্দ পেটে গোল খাচ্ছে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে লেখা মাথা হয়ে, হাত বেয়ে, কিবোর্ডে আনা যাচ্ছে না। কি এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

সন্ধ্যায় মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের লেখা বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন পড়তে বসেছি। ততোক্ষণে আমিও লেখকের সাথে আকাশে ভাসছি, হাওয়াই জাহাজে চেপে বিলেতের পথে। কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি বোধহয়, হঠাত মনে হলো এই বুঝি সব লেখা উপচে পড়লো। পড়িমরি করে ল্যাপটপটা খুঁজে নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। বাহ, কি চমৎকার! বহুদিন পর একের পর এক বিচিত্র রঙয়ের শব্দ সাজিয়ে মালা গাঁথছি। সে কি এক আনন্দানুভূতি, ইংরেজি ভাষার লম্বা এক শব্দ, Supercalifragilisticexpialidocious দিয়েও তা ব্যক্ত করার মতো নয়।

::

ফেসবুকে প্রতিদিন নতুন নতুন বই চোখে পড়ছে। দু’চারটা বইয়ের দোকানের ফেসবুক পেজের কল্যানে টামলাইন বইয়ে বইয়ে সয়লাব। তার উপর ফেব্রুয়ারি মাস। বাবা-মায়ের কল্যানে নিজের সংগ্রহে নতুন নতুন বই যোগ করছি। কিন্তু কোনভাবেই তাল মেলানো যাচ্ছেনা। একটা বই কিনতে না কিনতেই দেখি দশটা ততোধিক চমৎকার বই সামনে চলে এসেছে।

জীবনে যতো টাকা পয়সা আমার পকেটে এসেছে, অর্ধেক তার বই কিনেছি। বাকি অর্ধেক গাড়ি ভাড়া দিয়েছি। না গিয়েছি রেস্তোরাঁয়, না কিনেছি গ্যাজেট। শুধু বই আর বই। তারপরও এই যখন অবস্থা, তখন উদাস মনে ভর দুপুরে এক কাপ লেবু চা নিয়ে বইসংক্রান্ত উদারনৈতিক চিন্তায় মত্ত হওয়া ছাড়া উপায়ান্ত নেই।

এক. বিশেষ এক কাজে মাস-তিনেক টানা কক্সবাজার কাটিয়েছি। পুরো সময় জুড়ে আমি নিরিবিলি বসে পড়ার, উল্টেপাল্টে বই দেখার অভাব অনুভব করেছি প্রচন্ডভাবে। সরকারী পাঠাগার আছে একটা। কস্মিনকালে ফটক খোলা দেখিনি। আছে এক রক্ষিত মার্কেট। সব দোকান গাইড বই, চাকরীর বই আর বিসিএসের বইয়ে ভরা। দেশ জুড়ে একই অবস্থা। বাতিঘর, বেঙ্গল বই আর নীলক্ষেত বাদ দিলে দেশে আর তেমন কিছু আছে বলে মনে হয়না। আমি ভাবি, অপাঠ্য বই ছাড়া লোকজনের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়না?

দুই. ইউরোপের কোন একদেশ, সম্ভবত সুইডেনে লেখক কোন বই লিখলে সরকার প্রথম দুই বা চার হাজার কপি কিনে নিয়ে নিজ দায়িত্বে দেশের সব পাঠাগারে পাঠিয়ে দেন। কতো টাকা পাচার হয়, কতো টাকায় পর্দা-বালিশ কেনা হয়, অল্প টাকা খরচ করে কি সরকার এই কাজটা করতে পারেন না? অবশ্য পাঠাগার খোলা রাখাটাই যেখানে বিলাসিতা সেখানে আবার নিজ গরজে নতুন নতুন বই কেনা… কঠিনই বটে। তবে চিন্তা করতে তো আর দোষ নেই।

তিন. সহজে বই পাওয়ার উপায় কি? ভাবতে ভাবতে এক জিনিস মাথায় আসলো… শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে বই নিলে কেমন হয়? যৌতুক যে খারাপ সে আমি জানি, কিন্তু বই নিলে বোধহয় এতো বেশী খারাপ হবেনা। যাদের এতে আপত্তি নেই তারা আমার সাথে যোগাযোগ করুন। সরাসরি না বললেও ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে পারেন। বাকিটা বুঝে নিতে কষ্ট হবেনা। বিষয়টা যৌতুক পর্যন্ত না গড়ালেও অন্তত বিয়ের গিফট হিসেবে বই নির্ধারন করে দেয়া যায়।  

চার. লেখালেখির ব্যাপারটা ছোঁয়াচে। ভালো বই ফুলের মতো। আর পাঠকেরা হলেন মৌমাছির মতো। শুরুতে বলেছিলাম, বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন বইটা পড়ছি। পড়তে পড়তে মৌমাছির মতো রস আস্বাদন করছিলাম। মাঝপথে লিখালিখির বাতিক উঠলো। তাই বই রেখে লিখতে বসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সব রস বোধ হয় বিলিয়ে দেয়া শেষ।

কালো মেঘ সরে যাবে

একটা সময় ছিলো যখন মনে হতো আমাদের প্রজন্ম বোধহয় দেশটা ভালোই চালাতে পারবে। তাদের হাত ধরে আসবে পরিবর্তন। কিন্তু সেচিন্তায় নির্ভার থাকা আর হলো কোথায়? এই সময়ের তথাকথিত টিকটক সেলিব্রিটি অপু বাঁ মামুনের দিকে তাকালে আমার সব আশা ভেঁপুরের মতো উধাও হয়ে যায়। তাদের তৈরি করা কনটেন্ট নিয়ে সবার মাথায় হাত। সবার মনে অপু-মামুনের বিকৃত রুচি নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু হায়, নিজের রুচিবোধের দিকে একবার তাকানোর সময়ও হলো না। মানলাম, তাদের কনটেন্ট এর মান খুবই নিচু। তাই যদি হয়, তাহলে মানতেই হবে, আপনার আপনার-আমার রুচিবোধও কোন অংশে কম নিচু নয়। আমরাই তাদের ভিডিও দেখি, লাইক দিই বা শেয়ার করি। আমরাই তাদের সেলিব্রিটি বানিয়েছি। সেই আমরাই কিনা আবার অপু-মামুনদের কনটেন্ট নিয়ে নাক শিটকাই। দেখুন কান্ড!

গতো মাস-পাচেক ধরে সবাই ঘরে বসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও তাই অবস্থা। ওদিকে ক্লাসও হয়-হয়না অবস্থা। ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ সীমিত। এই সুযোগে সবাই আচ্ছামতো ঘুমাচ্ছে আর মুভি-নাটক দেখছে। সময়টাকে কাজে লাগানোর চিন্তা আছে কজনের? সারাদিন টইটই করে কাটিয়ে দেয়া এক বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম। তার উত্তর শুনে আমি অবাক হয়নি। বলেছে সবার যা হওয়ার তাই হবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কাছে এমন উত্তর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। অবসরে নিজেকে প্রডাক্টিভ কাজে যুক্ত করা বা নতুন কিছু শেখার মানসিকতা তার নেই। সে যে ‘সবার যা হওয়ার তাই হবে’ বলে বসে আছে, করোনা পরবর্তী সময়টা কেমন হবে সে চিন্তা উদয় হওয়ার ক্ষমতাটুকুও তার নেই।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন এমন হচ্ছে? দায়ের অর্ধেকটা সমাজের, বাকিটা শিক্ষাগত অবকাঠামোর। হোক অপু-মামুন অথবা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, দুইজনের সামনেই কোন এপ্রোপিয়েট আইডল নেই। তারা সবাই সস্থা নাটক বা হিরো আলমের ভিডিও দেখে এই পর্যায়ে এসেছে। সমাজ তাদের বুঝাতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ও সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপু-মামুনকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় নাভিদ মাহবুব কে অথবা উন্নয়ন অধ্যনে পড়া বন্ধুকে যদি জানতে চাওয়া হয় আহমেদ মুশফিক মোবারক কে তাহলে তাদের হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকবেনা। আমাদের সমাজ যদি এসব মানুষদের সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারতো, অথবা বিশ্ববিদ্যালয় যদি পারতো বোধ শক্তি জাগাতে, তাহলে পরস্থিতিটা অন্যরকম হলেও হতে পারতো। এসব ভালো কনটেন্ট বা ভালো মানুষকে যেমন যথাযতভাবে তুলে ধরা জরুরী, অন্যদিকে সমান জরুরী তেমন কিছুকে গ্রহণ করার রুচি। এসব মানুষগুলোকে আপনি দেখবেন অনুসরন করবেন, তাদের কাজ সম্পর্কে জানবেন, এভাবে একদিন নিজের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হবে, আপনি ধীরে ধীরে তাদের পর্যায়ে চিন্তা করতে শিখবেন – এভাবেই পরিবর্তন আসবে।

বস্তা পচা জিনিস খাবেন, আর পেট খারাপ হলে দুশ্চিন্তা করবেন, তা তো হবেনা! প্লিজ, অপু-মামুনের ভিডিও শেয়ার না দিয়ে কাজের কিছু শেয়ার করুন। ফান্ড রেইজার, নাভিদ মাহবুবের শ্যো বা অভিজিৎ ব্যানারজির কাজ নিয়ে ডকুমেন্টারি, যেকোন কিছু। তবুও অপু-মামুনের ভিডিও না! ভালো কাজ সম্পর্কে সবাই জানবে, সহযোগীতা করতে পারবে। ওদিকে নিম্নমানের কনটেন্টও জায়গা না পেয়ে উধাও হয়ে যাবে। সবার সবদিকে লাভ।

নিশ্চয় সুদিন আসবে। সূর্যের সামনে থেকে কালো মেঘ সরে যাবে। সেদিন সমাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে। পরিবেশটা বদলে যাবে। সে পরিবেশে অপু-মামুন সহ আমাদের সবার রুচিবোধ জাগ্রত হবে, আমার বন্ধু ভাবতে শিখবে, নির্ভীক কৌতূহলী হবে। সে দিনের প্রত্যাশায়।