তিন ভুবনের শিক্ষা ও আমার দু-পয়সা

Yusuf's Diary

তিন ভুবনের শিক্ষা ও আমার দু-পয়সা

তিন ভুবনের শিক্ষা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনেকেই আমাকে বইটি পড়তে বলেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে আমিও তড়িঘড়ি করে বইটা সংগ্রহ করি। এই বইয়ে মূলত জাপান, নেদারল্যান্ড এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী তিন বাবামা’র তাদের সন্তানকে গড়ে তোলার গল্প ও তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ে ভিনদেশে থাকা বাবামাদের যে অভিজ্ঞতা, তা পড়লে সহজেই বুঝা যায় কতো আয়োজন শিক্ষার্থীদের মানুষ বানানোর জন্য, সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য। বুঝতে পারবেন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের শিক্ষার্থীদের বইয়ের যাতাকলে নিষ্ঠুরভাবে পিষে ফেলার লোহমর্ষক বর্ণনাও।     

অনেকেই মনে করেন আচরণ, নীতি-নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব পরিবারের। স্কুল আমাদের শুধু পড়াশুনাটাই শেখাবে। স্কুলের পরিধি যে শুধু পড়াশুনা শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থা। শিশুদের পড়াশুনা জীবনের প্রথম দিন থেকে বই আর পরীক্ষার বোঝা না চাপিয়ে বরং তাদের মধ্যে আত্ননির্ভরশীলতা আর পারস্পরিক সহযোগীতার মানসিকতা গড়ে তোলাটাই তাদের প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। সাইকেল চালিয়ে দলবেঁধে স্কুলে যাওয়া, স্কুলে নিজের কাজ নিজে করা এবং বিশেষ করে বাড়িতে বাবামার কাজে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো শ্রেণীকক্ষেই শেখানোর ব্যাপারগুলো সত্যি প্রশংসাযোগ্য।

মূল্যায়ন পদ্ধতি যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর কথা তাই আলাদা করে বলতেই হয়। এইদিকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ডাচরা। শুধু ক্লাসের পারফর্মেন্স বা পরীক্ষার খাতার ক’টা লাইন দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়না। বরং সামগ্রিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটাকে তারা ভাগ করেছে তিনভাগে। কোনো শিক্ষার্থীর সামাজিক, মানসিক এবং একাডেমিক উন্নতিকে এই মুল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করা হয়। তাদের ক্লাসে রোল নম্বর টাইপ কিছু নেই। তারা মনে করে, এর ফলে ছোটছোট শিক্ষার্থীদের মনে ভেদাভেদ, উঁচুনিচুর বীজ বপন হতে পারে। ফলাফল তৈরির পর থাকে বাবামা’র সাথে শিক্ষদের এক-এক (ওয়ান-অন-ওয়ান) আলোচনা, যার উদ্দেশ্য সন্তানের সামগ্রিক উন্নতিকে কিভাবে আরও গতিশীল করা যায় তার কাস্টমাইজড এবং পার্সোনালাইজড সাজেশন দেয়া।

সার্টিফিকেট পরিক্ষাগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রান ভোমরা। কতো-শতো প্রস্তুতি আমাদের বাবামাদের, কতো ত্যাগ, মাস-ছয়েক আগে থেকে বাসায় আত্নীয়স্বজনদের আসা নিষেধ – কারন সামনে বোর্ড পরিক্ষা। আর যাই হোক, এ প্লাস মিস করা যাবেনা। ছেলেমেয়ে এ প্লাস না পেলে লজ্জায় মুখ দেখাবে কীভাবে? এদিকে শিক্ষার্থীদের অবস্থাও কাহিল। ভোরে কোচিং দিয়ে শুরু, তারপর স্কুল, সেখান থেকে কোচিং, তারপর বাসায় এসে কাপড়চোপড় খুলতে না খুলতেই টিউটর। টিউটর চলে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় বাবামা’র খবরদারী… পড়া, পড়া আর পড়া। সত্য কথা বলতে, পড়াশুনার মধ্যে এতো ডুবিয়ে রাখতে রাখতে তাদের যে একটা জীবন আছে, আমাদের বাবামা’রা সেটাই ভুলে গেছেন। বাস্তবজ্ঞানকে পাশে ঠেলে মাত্রাতিরিক্ত বই মুখিতার ফলে যেমন শেখাটা হচ্ছেনা, অন্যদিকে জীবনের অন্যদিকগুলোও হারিয়ে ফেলছি। ফলাফল শূণ্য। না শিখতে পারছি, না পারছি দক্ষতা অর্জন করতে। তাদের বোর্ড পরীক্ষা আছে, আছে সে পরীক্ষার সংশ্লিষ্ট একটা বোর্ডও, তবে তার উদ্দেশ্য যতোটা না পরীক্ষা নেয়া, তারচেয়ে ঢের বেশী হলো পরীক্ষার ভীতিকর পরিবেশ দূর করা। আর যাই হোক, শিশুদের কোমল মনে পড়াশুনা নিয়ে ভীতি তৈরি হতে দেয়া যাবেনা।

নীম পাতার পুষ্টিগুণ নিয়ে কারও কোন দ্বিধা নেই। তাই বলে তিতা নিমের কাঁচা রস যদি খেতে দেয়া হয় তাহলে কি পেটে চালান করা সম্ভব? মোটেও না। জ্ঞানের ব্যাপারটা তেমনই। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভাবনা আছে শিক্ষাকে ঘীরে। তিনি বলেছেন, খাওয়া খেতে গেলে সাথে না চাইলেইও কিছু হাওয়া আপনার পেটে চলে যাবে। এই হাওয়া, খাওয়ারই একটা অংশ। আপনি জোর করে পেটে হাওয়া ঢুকা বন্ধ করতে চাইলে খাওয়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলছি এমন এক ভয়ংকর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, যেখানে তাদের জোর করে গুনাগুন সমৃদ্ধ তিতা নিমের রস খাইয়ে দেয়া হয়। আর ছেলেমেয়েরা এর তেজ সহ্য করতে না পেরে বমি করে দেয়। বলি কি, ছাত্রছাত্রীদের বর্ষাকাল রচনা মুখস্ত করতে না দিয়ে তাদের নিয়ে কোন এক বর্ষামুখর দিনে বেরিয়ে পড়ুন। অথবা দলবল নিয়ে নৌকা ভ্রমনে যান। দেখবেন, তারা নিজেরাই কতো অসাধারণ বর্ননা দিবে। অবশ্য এতো বর্ষায় ভেজা আর নৌকা ভ্রমণ দিয়ে কি হবে? এসব দিয়ে কি আর এ প্লাস পাওয়া যায়?    

কাজের কথায় আসি – শিক্ষা ব্যবস্থা একটা সামগ্রিক ব্যাপার। শিক্ষার্থী, বাবামা আর শিক্ষকেরা এর প্রধান অংশীদার। সবারই সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে এই ব্যবস্থা। এই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারের কাজ হবে ছাত্রছাত্রীদের বিকশিত হওয়ার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। সমাজের কাজ হবে পরিবর্তনকে উৎসাহিত করা। আর বাচ্চাদের কাজ হবে নিয়মনীতি আয়ত্বে আনা, দায়িত্ব পালন করা। তাহলেই বদলে যাবে দেশ ও জাতীর ভবিষ্যৎ।

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.
Back To Top