কৃষি – দূর ও অদূর

Yusuf's Diary

কৃষি – দূর ও অদূর

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিলো মাত্র সাড়ে সাত কোটি। অথচ তখন দেশের অধিকাংশ লোকের কপালে তিনবেলা খাবার জুটতো না। ১৯৭৪ সালে পরিস্থিতির আরও খারাপ হয়ে যায়। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মারা যায় প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। বিগত ৪০ বছরে কমতে কমতে সেটা ৮ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টরে ঠেকেছে। এদিকে জনসংখ্যা ছুঁয়েছে ১৭কোটি। এমন অবস্থাতে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। এই সাফল্য শুধু ধানে নয়। আলু, সবজী, মাছ, চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদিতেও উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম সারিতে আছে বাংলাদেশ। আশার আলো দেখিয়েছে ফুল, পোল্ট্রি, ডেইরির মতো কৃষি পণ্যও।  

করোনার তান্ডবে বিধ্বস্ত বিশ্ব। গোটা দুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। লকডাউন করে দেয়ায় থমকে আছে সবকিছু। সবার মতো ঘরে বসে আছেন দেশের প্রায় ৭৩ লাখ কৃষিশ্রমিক। অথচ এখন তাদের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় পার করার কথা। শুধু ধানের কথাই যদি বিবেচনা করি, এবছর দেশে ৪১ লাখ হেক্টরের বেশী জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। সেগুলো ঘরে উঠবে কীভাবে? আশংকা অন্য কৃষি পন্যেও। দুগ্ধ খামারিদের দুধ উৎপাদন সীমিত করতে হয়েছে। পোল্ট্রি শিল্পে প্রতিদিন বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। সবচেয়ে বিপাকে ফুল চাষিরা। এ খাতে সম্পৃক্ত প্রায় ৫০ লাখ লোক, যাদের শুধু ফুলই নষ্ট হয়েছে আড়াই’শ কোটি টাকার।    

এই সংকট কতোদিনে কাটবে সেটা বলা মুশকিল। তাই এই মুহূর্তে চেষ্টা করতে হবে মাঠের ফসল ঘরে তোলার। অন্যথায় এতোদিনের শ্রম বৃথা যাবে। সরকার অবশ্য সেদিকে নজরও নিয়েছে। হাওড় অঞ্চলে শ্রমিক সংকট মেটাতে তালিকা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় রিপার, হারভেস্টারের ব্যবস্থা করা ও ধান কেনার উদ্যোগ নেইয়া হয়েছে। করোনা পরবর্তী অর্থনীতিতে প্রান ফিরাতে সম্প্রতি সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশের সবচেয়ে বড়, পরিপক্ষ এবং ধনী গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ২% সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ দরিদ্র কৃষকেরা তা পাচ্ছেন ৫% হারে।

গার্মেন্টস শিল্প, মানব সম্পদ রপ্তানি ও কৃষি দেশের অর্থনীতির প্রধান তিনটি ভিত। তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, দেশের ইতিহাসে যেকোন সময় অন্যদুটি ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষি ততোটা প্রাধান্য পায়নি। দেশের অর্থনীতিকে পুনরায় দাড় করানোর ক্ষমতা কৃষির আছে বলে বিশ্বাস করেন সব অর্থনীতিবিদেরাই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করে যেসব দেশ রপ্তানি করতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে এবং এগিয়ে যাবে। তাই, এই আশার আলোকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন টেকসই কৃষি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা। এর জন্য আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘ, দুই মেয়াদে চিন্তা করতে হবে।

স্বল্প মেয়াদের প্রেক্ষিতেঃ এই স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হলো করোনাকালীন এই বিশেষ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠা। এজন্য প্রস্তাবনাগুলো হলোঃ

  • সরকারকে শুধু ধান কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধানের মতো অন্য কৃষিপন্যকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হবে।   
  • দেশজুড়ে বিরাজমান লকডাউন পরিস্থিতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু ওদিকে ফসল তোলাও জরুরী। এক্ষেত্রে আমাদের প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। সরকারের উচিৎ শুধু হাওড় নয়, সারাদেশে পর্যাপ্ত আধুনিক রিপার-হারভেস্টারের ব্যবস্থা করা।
  • যেহেতু বাজারে কেনার মতো লোক নেই, সরকারীভাবে কৃষিপণ্য কেনার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। এতে ফসল নষ্ট হবে না। আবার কৃষক ন্যায্যমূল্যও পাবে। এসব পণ্য সরকার স্বল্প মূল্যে অথবা ত্রাণ হিসেবে মানুষজনকে বিতরন করতে পারে। আবার অতিরিক্ত পণ্য মজুদ করতে পারে ভবিষ্যতের জন্য।
  • সমালোচিত ঋণহার কমিয়ে অন্ততপক্ষ্যে ২% বা তার কাছাকাছি আনতে হবে। এমনিতেই ব্যাংক ব্যবস্থা এখনো কৃষক পর্যায়ের কারও জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেনি। তার উপর উচ্চমাত্রার ঋণ হার তাদের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আরও দূরে ঠেলে দিবে। শেষমেশ কাজের কাজ কিছুই হবে না।

দীর্ঘ মেয়াদের প্রেক্ষিতেঃ এই পরিকল্পনার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো কৃষিকে নতুন মাত্রা দেয়া, নতুন উচ্চতায় পৌঁছানো। এজন্য সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু করনীয় রয়েছে। যেমনঃ

  • বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশী কৃষিপণ্যের অবস্থান একদম নীচের সারিতে। এর অন্যতম বাঁধা হচ্ছে পণ্যে ভেজাল ও উচ্চ মুনাফার লোভ। তাই, দেশের স্বার্থে সরকারের প্রতক্ষ্য ভূমিকায় শতভাগ রপ্তানিমুখী ইপিজেড স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে সরকার নিজেই মান নিয়ন্ত্রণ ও দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
  • প্রয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে ও দূতাবাসগুলোর সহায়তায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কৃষিপণ্য আমদানিকারক দেশগুলো থেকে ব্যবসায়ীদের নিয়ে এসে সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ঘুরে দেখাতে হবে। এতে দেশের কৃষিপণ্যের উপর হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।   
  • তরুণদের কৃষির দিকে আগ্রহ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের তরুণেরা খুব মেধাবী। তাদের এদিকে মনোযোগ আনা গেলে কৃষিতে নতুন নতুন উদ্ভাবন আসবে। বিচিত্রতা আসবে। আসবে গতি। আমাদের গতানুগতিক কৃষকেরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষম। সে জায়গায় তরুনের এলে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও ফল ভোগও সহজ হবে।
  • গার্মেন্টস শিল্পের জোট বিজিএমইএ এর মতো শক্ত কোন সংগঠন কৃষি পর্যায়ে না থাকায় নিজেদের মতামত তুলে ধরা, সরকারী সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ বা অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছেন আমাদের কৃষকেরা। অথচ তাদের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। এজন্য কৃষির ক্রমাগত উন্নয়নে এমন প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।                  

এই বৈশ্বিক ক্রান্তিলগ্নে থমকে আছে বিশ্ব। ঠিক এমন সময়ে আশার আলো দেখাচ্ছে আমাদের কৃষক ও কৃষি। যে সস্থা শ্রম এ দেশে গার্মেন্টসকে টিকিয়ে রেখেছে, অটোমেশনের এই যুগে সেটির তো আর কদর থাকবে না। সব ভর গার্মেন্টসের উপর কেন? কৃষির উপরও কিছু পড়ুক। সে সম্ভাবনা তো তাদের আছেই।

তথ্যসূত্রঃ

  1. https://www.prothomalo.com/opinion/article/1657135/%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B6%E0%A6%BE-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%B0
  2. https://cpd.org.bd/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%b7%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a6%a3%e0%a7%8d%e0%a6%af/
  3. https://www.bd-pratidin.com/editorial/2020/04/18/521768
  4. https://www.prothomalo.com/opinion/article/1648195/%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF-%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%95
  5. http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/%E0%A7%A7%E0%A7%AA%E0%A7%A8%E0%A7%A8/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%A3%20%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%20%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%A8%20%E0%A6%93%20%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%95%20%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A7%9F%20%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF
  6. http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/%E0%A7%A7%E0%A7%AA%E0%A7%A8%E0%A7%A8/%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%96/%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%BF%20%E0%A6%93%20%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A7%87%20%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%20%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0
  7. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A7%A7%E0%A7%AF%E0%A7%AD%E0%A7%AA-%E0%A6%8F%E0%A6%B0_%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7
  8. https://www.bbc.com/bengali/news/2012/07/120716_mk_bangla_census
  9. https://bangla.dhakatribune.com/opinion/2020/01/31/19658/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8
  10. https://www.bd-pratidin.com/editorial/2018/09/06/358286
Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.
Back To Top