বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন

Yusuf's DiaryLeave a Comment on বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন

বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চেহারা বোঝা যায় সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারায় তাকিয়ে। একটা মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তার আশেপাশের এলাকার আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে দেশবিদেশের মেধাবীরা ভিড় জমায়। হয়ে উঠে আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কেন্দ্রস্থল। জানার অবারিত সুযোগ তৈরি হয়। সেখানে চলে মুক্তচর্চা, থাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকের সাথে মেলামেশা ছাত্রছাত্রীদের উদার ও প্রগতিশীল করে তোলে। সেখান থেকে বের হয় বিশ্বসেরা উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা আর প্রতিষ্ঠান।   

দেশে একের পর এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হতেই আছে। সরকারী-বেসরকারি মিলিয়ে যা ১৫০ এর উপরে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে খুব একটা। বরং কমছেই বলা চলে। আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংগুলো যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া হয় তার অন্যতম হলো প্রকাশিত ছাত্রশিক্ষক অনুপাত, পিএইচডিধারী গবেষক ও গবেষণাপত্রের সংখ্যা, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের জবপ্লেসমেন্ট এসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং এ আমাদের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান থাকে নীচের সারিতে। তার মানে আমরা বিবেচিত বিষয়গুলোর প্রায় সবগুলোতেই পিছিয়ে আছি।

শুধু ২০১১-২০১২ অর্থ বছরেই লন্ডন শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় ৬বিলিয়ন ইউরোর সমপরিমান অবদান রেখেছে। তার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ১লাখ ৪৫হাজার ৯২১টি চাকরী। তাহলে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালগুলোর প্রভাব কিংবা ভূমিকাটা কেমন? জরিপ বলছে দেশের ৪৭% গ্র্যাজুয়েট বেকার। আমরা দেখি ভারত, চীন আর শ্রীলংকানদের আধিপত্য রয়েছে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের শীর্ষপদগুলোতে। ৩ লাখ বিদেশী নাগরিক প্রতিবছর ৪০ হাজার কোটি টাকা এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে। তার মানে বিশ্ববিদ্যালগুলো ছাত্রছাত্রীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারছে না, বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই তারা অঢেল টাকা খরচ করছেন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিতে। চায়নার China’s 985 প্রোজেক্ট, জাপানের Centres of Excellence, কোরিয়ার Brain Korea 21, এবং জার্মানির Centres of Excellence প্রোজেক্ট এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।      

তাহলে আমাদের সরকার কেন মান বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে সংখ্যায় নজর দিচ্ছে? যুক্তি আছে বটে – আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ’ এর গবেষকদের করা এক গবেষণা বলছে একটা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সেদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার খুব পোক্ত সম্পর্ক রয়েছে।          

৭৮টি দেশের ১৫০০ এলাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পরিচালিত এই গবেষণা বলছে “কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হলে সে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪% পর্যন্ত বাড়তে পারে” 

কি? বিশ্বাস হচ্ছে না? “The contribution of university rankings to country’s GDP per capita” শিরোনামে ঠিক একই ধরনের একটি গবেষণা করেছেন নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের গবেষকেরা, যারাও একই কথাই বলছেন। তারা আরও বলছেন “এই আশানুরূপ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে হলে শুধু অল্পকিছু বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির চেয়ে ভালোমানের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির দিকেই মনোযোগ দিতে হবে” – সমস্যা হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে পারলেও তার একটা সম্মানজনক মান দিতে ব্যর্থ।   

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমস্যায় ঠাসা। নোংরা রাজনীতির কালো থাবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব সম্ভাবনা ধুলোয় মিশিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পরিচালনা – এমন কোন স্তর নেই যেখানে পচন ধরায়নি। তার ফলে মেধার প্রকাশ, বিকাশ আর পরিচর্যার কেন্দ্রস্থল হওয়ার বদলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে আবর্জনার ভাগাড় আর মেধাবীদের মৃত আত্নার গোরস্থান। ফলে সেখানে আবিষ্কার-উদ্ভাবন দূরে থাক, নিয়মিত পড়াশোনাটাই হয়না। অথচ দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হতে পারতো দেশের উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার, নিয়ে যেতে পারতো সাফল্যের চুড়ায়। 

বিশ্ববিদ্যালয় আর ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পর্ক অপরিহার্য। ইন্ডাস্ট্রি স্মার্ট গ্র্যাজুয়েট চায় অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগ করতে যত অনাগ্রহ তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিনিয়োগ সবার জন্য লাভজনক। গবেষণা বলছে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় প্রতি এক ইউরো বিনিয়োগে সরাসরি পাওয়া যায় ৯.৭ইউরো। পরোক্ষভাবে পাওয়ার যায় অতিরিক্ত ৩.৩৬ইউরো। তারা নিশ্চয়ই এটা জানেন না।            

এই বিশ্ববিদ্যালগুলোকে বাঁচাতে পারলে, বেঁচে যায় গোটা দেশ। লাখ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং হয়, হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উদাও হয়ে যায়, একেকটা পর্দা আর বালিশ লাখ টাকায় কেনা যায়, পুকুর খনন দেখতে গ্রুপে গ্রুপে বিদেশ সফর করতে যায়, কোটি টাকা ব্যায়ে গুলশানে মুভিং রোডের মতো অকাজের প্রোজেক্ট হাতে নেয়া যায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাকা পায়না গবেষণা করার, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার। বিশ্ববিদ্যালগুলোকে ভোট ব্যাংক কিংবা নোংরা রাজনীতির উৎস না বানিয়ে তাদের আসল কাজ করতে দিন। উচ্চশিক্ষা আর গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্ধ দিন, মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন, লবিং কিংবা উচ্চ সিজিপিএ’র বদলে গবেষণা ও তার আম্ন দেখেই শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন দিন, দেখবেন দেশ বদলে যাচ্ছে। সেখানকার ছাত্রশিক্ষকেরা তখন আর গবেষনাপত্র চুরি করছেনা, আমেরিকা থেকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে হচ্ছেনা, রাশিয়া থেকে লোক এনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ বানাতে হচ্ছেনা, চীন থেকে প্রকৌশলী এনে পদ্মাব্রীজ বানাতে হচ্ছেনা। এমন নিজ হাতে গড়া স্বনির্ভর উন্নত দেশই নিশ্চয়ই জাতীর পিতার স্বপ্নে ছিলো।         

তথ্যসূত্রঃ   

[১] https://www.businessinsider.com/link-between-universities-in-a-country-and-gdp-2016-8

[২] https://mpra.ub.uni-muenchen.de/53900/1/MPRA_paper_53900.pdf

[৩] https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0272775718300414

[৪] https://link.springer.com/article/10.1007/s10961-013-9320-0

[৫] https://theconversation.com/seven-ways-universities-benefit-society-81072

[৬ ] https://www.dhakatribune.com/bangladesh/education/2019/05/24/six-bangladeshi-universities-in-qs-asia-ranking

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top