তিন ভুবনের শিক্ষা ও আমার দু-পয়সা

তিন ভুবনের শিক্ষা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে অনেকেই আমাকে বইটি পড়তে বলেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে আমিও তড়িঘড়ি করে বইটা সংগ্রহ করি। এই বইয়ে মূলত জাপান, নেদারল্যান্ড এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী তিন বাবামা’র তাদের সন্তানকে গড়ে তোলার গল্প ও তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ে ভিনদেশে থাকা বাবামাদের যে অভিজ্ঞতা, তা পড়লে সহজেই বুঝা যায় কতো আয়োজন শিক্ষার্থীদের মানুষ বানানোর জন্য, সময়ের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য। বুঝতে পারবেন উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের শিক্ষার্থীদের বইয়ের যাতাকলে নিষ্ঠুরভাবে পিষে ফেলার লোহমর্ষক বর্ণনাও।     

অনেকেই মনে করেন আচরণ, নীতি-নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব পরিবারের। স্কুল আমাদের শুধু পড়াশুনাটাই শেখাবে। স্কুলের পরিধি যে শুধু পড়াশুনা শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থা। শিশুদের পড়াশুনা জীবনের প্রথম দিন থেকে বই আর পরীক্ষার বোঝা না চাপিয়ে বরং তাদের মধ্যে আত্ননির্ভরশীলতা আর পারস্পরিক সহযোগীতার মানসিকতা গড়ে তোলাটাই তাদের প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। সাইকেল চালিয়ে দলবেঁধে স্কুলে যাওয়া, স্কুলে নিজের কাজ নিজে করা এবং বিশেষ করে বাড়িতে বাবামার কাজে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো শ্রেণীকক্ষেই শেখানোর ব্যাপারগুলো সত্যি প্রশংসাযোগ্য।

মূল্যায়ন পদ্ধতি যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর কথা তাই আলাদা করে বলতেই হয়। এইদিকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ডাচরা। শুধু ক্লাসের পারফর্মেন্স বা পরীক্ষার খাতার ক’টা লাইন দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়না। বরং সামগ্রিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটাকে তারা ভাগ করেছে তিনভাগে। কোনো শিক্ষার্থীর সামাজিক, মানসিক এবং একাডেমিক উন্নতিকে এই মুল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করা হয়। তাদের ক্লাসে রোল নম্বর টাইপ কিছু নেই। তারা মনে করে, এর ফলে ছোটছোট শিক্ষার্থীদের মনে ভেদাভেদ, উঁচুনিচুর বীজ বপন হতে পারে। ফলাফল তৈরির পর থাকে বাবামা’র সাথে শিক্ষদের এক-এক (ওয়ান-অন-ওয়ান) আলোচনা, যার উদ্দেশ্য সন্তানের সামগ্রিক উন্নতিকে কিভাবে আরও গতিশীল করা যায় তার কাস্টমাইজড এবং পার্সোনালাইজড সাজেশন দেয়া।

সার্টিফিকেট পরিক্ষাগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রান ভোমরা। কতো-শতো প্রস্তুতি আমাদের বাবামাদের, কতো ত্যাগ, মাস-ছয়েক আগে থেকে বাসায় আত্নীয়স্বজনদের আসা নিষেধ – কারন সামনে বোর্ড পরিক্ষা। আর যাই হোক, এ প্লাস মিস করা যাবেনা। ছেলেমেয়ে এ প্লাস না পেলে লজ্জায় মুখ দেখাবে কীভাবে? এদিকে শিক্ষার্থীদের অবস্থাও কাহিল। ভোরে কোচিং দিয়ে শুরু, তারপর স্কুল, সেখান থেকে কোচিং, তারপর বাসায় এসে কাপড়চোপড় খুলতে না খুলতেই টিউটর। টিউটর চলে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় বাবামা’র খবরদারী… পড়া, পড়া আর পড়া। সত্য কথা বলতে, পড়াশুনার মধ্যে এতো ডুবিয়ে রাখতে রাখতে তাদের যে একটা জীবন আছে, আমাদের বাবামা’রা সেটাই ভুলে গেছেন। বাস্তবজ্ঞানকে পাশে ঠেলে মাত্রাতিরিক্ত বই মুখিতার ফলে যেমন শেখাটা হচ্ছেনা, অন্যদিকে জীবনের অন্যদিকগুলোও হারিয়ে ফেলছি। ফলাফল শূণ্য। না শিখতে পারছি, না পারছি দক্ষতা অর্জন করতে। তাদের বোর্ড পরীক্ষা আছে, আছে সে পরীক্ষার সংশ্লিষ্ট একটা বোর্ডও, তবে তার উদ্দেশ্য যতোটা না পরীক্ষা নেয়া, তারচেয়ে ঢের বেশী হলো পরীক্ষার ভীতিকর পরিবেশ দূর করা। আর যাই হোক, শিশুদের কোমল মনে পড়াশুনা নিয়ে ভীতি তৈরি হতে দেয়া যাবেনা।

নীম পাতার পুষ্টিগুণ নিয়ে কারও কোন দ্বিধা নেই। তাই বলে তিতা নিমের কাঁচা রস যদি খেতে দেয়া হয় তাহলে কি পেটে চালান করা সম্ভব? মোটেও না। জ্ঞানের ব্যাপারটা তেমনই। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভাবনা আছে শিক্ষাকে ঘীরে। তিনি বলেছেন, খাওয়া খেতে গেলে সাথে না চাইলেইও কিছু হাওয়া আপনার পেটে চলে যাবে। এই হাওয়া, খাওয়ারই একটা অংশ। আপনি জোর করে পেটে হাওয়া ঢুকা বন্ধ করতে চাইলে খাওয়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলছি এমন এক ভয়ংকর পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, যেখানে তাদের জোর করে গুনাগুন সমৃদ্ধ তিতা নিমের রস খাইয়ে দেয়া হয়। আর ছেলেমেয়েরা এর তেজ সহ্য করতে না পেরে বমি করে দেয়। বলি কি, ছাত্রছাত্রীদের বর্ষাকাল রচনা মুখস্ত করতে না দিয়ে তাদের নিয়ে কোন এক বর্ষামুখর দিনে বেরিয়ে পড়ুন। অথবা দলবল নিয়ে নৌকা ভ্রমনে যান। দেখবেন, তারা নিজেরাই কতো অসাধারণ বর্ননা দিবে। অবশ্য এতো বর্ষায় ভেজা আর নৌকা ভ্রমণ দিয়ে কি হবে? এসব দিয়ে কি আর এ প্লাস পাওয়া যায়?    

কাজের কথায় আসি – শিক্ষা ব্যবস্থা একটা সামগ্রিক ব্যাপার। শিক্ষার্থী, বাবামা আর শিক্ষকেরা এর প্রধান অংশীদার। সবারই সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে এই ব্যবস্থা। এই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারের কাজ হবে ছাত্রছাত্রীদের বিকশিত হওয়ার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। সমাজের কাজ হবে পরিবর্তনকে উৎসাহিত করা। আর বাচ্চাদের কাজ হবে নিয়মনীতি আয়ত্বে আনা, দায়িত্ব পালন করা। তাহলেই বদলে যাবে দেশ ও জাতীর ভবিষ্যৎ।

অন আ ব্রেক

ঘড়িতে যখন সকাল সাড়ে ছয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে একটু হকচকিয়ে গেলো রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “কি খবর? কেমন যাচ্ছে সবকিছু?” শীতের সকাল। অন্যদিন হলে শীতকে জয় করে গায়ে জড়ানো লেপ ছেড়ে হিমশীতল পানিতে মুখহাত ধুতেই পাক্কা একঘন্টা লাগিয়ে দেয়ার কথা। আজকে তার ব্যতিক্রম। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রিশান। জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নন্দনকাননের যে বাড়িটায় থাকে, সেখান থেকে জানালা দিয়ে ডিসি হিলের খুব সুন্দর একটা অংশ দেখা যায়। কৃষ্ণচূড়ার গাছটা লালে-লাল হয়ে আছে। কোথা থেকে একটা শালিক পাখি এসে বসেছে। এই বাসাটায় রিশান আছে গতো তিন বছর ধরে। প্রতিদিন কাঁক দেখা যায়, চড়ুই দেখা যায়, মাঝে মাঝে ময়নাও দেখা যায়। কিন্তু শালিক কখনো চোখে পড়েনি তার। পাখিটার দিকে গভীর মনোযোগে তাকাতেই একসাথে অনেকগুলো স্মৃতি ধরা দিলো। যেন শালিকটা দুইপাখা বোঝাই করে এনেছে সেগুলো। যেই স্মৃতি রোমন্থনে ডুব দিবে, অমনিতে বিকট শব্দে তার মনোযোগ ভিন্নদিকে চলে গেলো। মোড়ের ট্রান্সফরমারটা ফুটে গেছে। পরক্ষনে অনেকগুলো কাঁককে দেখা গেলো কাঁ-কাঁ করতে ঝাক বেঁধে ওদিকে যেতে। তাদের দলের কোন কাঁক হয়তো মারা গেছে ঐ ট্রান্সফরমারে।

সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরে ভার্সিটিতে যাবে রিশান। এরই মধ্যে বিশ মিনিট চলে গেছে। আপাতত স্মৃতিচারনের সময় নেই। কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে শীতের কাপড়টা গায়ে চাপিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। একটা রিকশা নিয়ে পৌঁছে যায় ষ্টেশনে। এখন আর আগের মতো ফ্যামিলি বগিতে বসার তাড়া নেই। শাটলে পলিটিক্স বন্ধ করে দেয়ায় রিশানের ভালোই হয়েছে। কোন একটাতে উঠে গেলেই হলো, সোজা ভার্সিটি পৌঁছে যাওয়া যায়। একটু পর শাটল চলতে শুরু করলো। জানালার পাশের একটা সিটে রিশান বসে আছে। ব্যাগ থেকে সমরেশ মজুমদারের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ বের করেছে। বই খুলে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ার আগ্রহ নেই। তাঁর মনোযোগের পুরোটা জুড়ে তানিশার ঐ টেক্সটটা। আবার সে ভাবনার রাজ্যে ডুব দিলো…

তানিশার সাথে তাঁর দেখা হয় ভার্সিটি কোচিং এর সময়। প্রথমে ক’দিন চকবাজারে করলেও এতো লোকের আনাগোনা ভালো না লাগায় জিইসিতে চলে আসে রিশান। সেখানেই তাদের দেখা। দুজনই পড়াশুনায় ভালো। কোচিং এর মডেল টেস্টে প্রথম দিকে থাকতো তারা। একজন আরেকজন থেকে নোট ধার নিতো, পড়া বুঝিয়ে নিতো। আবার কোনদিন দুজনে বই নিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। কাজের-অকাজের কথা, নিয়মিত দেখা হওয়া, একই ভালো লাগার বিষয় – একটা ফ্রেন্ডশিপকে এগিয়ে নেয়ার উপঢৌকন হিসেবে যা দরকার, তার সব ছিলো তাদের মধ্যে। ঐ উঠতি বয়সে যেমনটা হয়, কোচিং এর এক ছেলেকে ভালো লাগা শুরু হয় তানিশার। ছেলে মানে, কোচিং এ ক্লাস নেন। সাধারণ জ্ঞানটা ভালোই পড়ায়। ভালো লাগার ব্যাপারটা রিশানকে জানায় সবার আগে। প্রেমট্রেম নিয়ে রিশানের খুব একটা আগ্রহ ছিলনা। রিশান টুকটাক পরামর্শ দিতো আর সুযোগ বুঝে মজা করতো, খেপাতো। কিন্তু তানিশা’র আগ্রহের তীব্রতা দেখে তার অস্বস্তি শুরু হয়।

অজান্তে বন্ধুর চেয়ে বিশেষ কোন জায়গা দিয়েছিলো তানিশাকে? নাকি উঠতি বয়সের মায়া? এসব প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খায়। এদিকে তানিশাও অবস্থা বুঝে দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেই যে দূরে চলে যাওয়া, আর কাছে আসা হয়নি, যোগাযোগ হয়নি। অবশ্য, যোগাযোগ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেটা বললে খানিকটা ভুল হবে। রিশান টুকটাক খবরাখবর রাখতো। জেনেছিলো, ছেলেটার সাথে নাকি একসময় সত্যি সত্যি সম্পর্কে জড়ায় তানিশা। তারপর আর কি হলো তার ধারণা নেই। শাটল ভার্সিটির ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে। রিশান গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত সকালের নাস্তাটা সেরে ক্লাস ধরতে গেলো।

সারাদিন ঝামেলার মধ্যে টেক্সটের উত্তর দিতে ভুলে গেছে রিশান। খেয়ালই ছিলনা। সেদিন সন্ধায় বাসায় ফিরে ফোন হাতে নিলো উত্তর দিবে ভেবে। আরেকটা টেক্সট এসেছে তানিশার নাম্বার থেকে। “বুঝতে পেরেছি, বহুদিনের চাপা ক্ষোভের ভার উপড়ে উত্তর দেয়ার আগ্রহ পাওনি হয়তো। কাল বিকেল পাঁচটায়, রিওতে চলে এসো”। রিশান এবার অনেকটা দায়সারা উত্তর দিলো – “আচ্ছা”।  

তানিশা আগে এসেছে। দরজায় অপেক্ষা করছে রিশানের জন্য। রিকশা থেকে নামতেই যখন তানিশাকে চোখে পড়লো। দুই বছরে অনেক বদলেছে সে, কিন্তু একেবারে না চেনার মতো নয়। এক চিলতে মুচকি হাসি আর ভাব বিনিময়ের পর দুজনে উপরে উঠে গেলো। ক্যাফের দক্ষিন পাশটা একটু নিরব। সেখানের দুটো চেয়ারে বসে আলাপ শুরু হলো তাদের। নিজের জন্য একটা লাটে অর্ডার করেছে। রিশান কিছু খেতে চায়নি। পরে অনেকটা জোরাজোরির পর একটা এস্প্রেসো দিতে বলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কতোকিছু উঠে আসে সেদিন। পরিবার, পড়াশুনা, ভবিষ্যৎ ভাবনা সহ কতো কিছু। কিন্তু একটা বিষয় বেশ সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেলো তানিশা – ব্যক্তিগত জীবন। রিশানও বুঝতে পেরে খুব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। হয়তো ভালো যাচ্ছে না। বুঝতে অসুবিধে হলো না, কৈশোরের অস্থিরতা আর নেই। শান্ত আর ধিরস্থির আর সবকিছুতে পরিপক্ষতার ছাপ। এতোদিন পরে দেখা, কিন্তু আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই কথায়। একদম ভার্সিটি কোচিংয়ের দিনগুলোর মতো। পারলে খানিকটা বেশী বলা চলে। অনেকদিন পর দেখা বলে এমনটা হতে পারে। কে জানে?

ছেলেমানুষী স্রোত নাকি বর্ষায় তীব্র হয়, চৈত্রে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু নদীতে বোধ হয় বর্ষা ফিরে এসেছে। স্রোত তার তীব্রতা ফিরে পেয়েছে ধীরে। রিশান আর তানিশা ঘন্টার পর ঘন্টা বাতিঘরে বই বাছাই করে কাটিয়েছে, রিকশায় সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে বা কোনদিন ভোরে দুজনে সিআরবি’তে চরকির মতো ঘুরেছে – এভাবে নানান ছলে দুজনের কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে, ভাবের বিনিময় হয়েছে, আর সম্পর্কটা পরিপক্ষ হয়েছে।

কোন এক সকাল। ঘড়িতে যখন সকাল নয়টা, এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মুছতে মুছতে প্রতিদিনকার মতো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে রিশান। সকাল সকাল তানিশার টেক্সট। তাতে লেখা – “আজকে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। রিও’তে বিকাল চারটা”। শনিবার, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এদিকে তানিশার সাথে দেখা হবে বিকালে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠার তাড়া নেই রিশানের। বিছানায় শুয়েই জানালার বাইরেরটা দেখা যায়। হঠাত মনে হলো, আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। কি যেন নেই-নেই ভাব। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো, ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো রিশান। কৃষ্ণচূড়া গাছ, টকটকে লাল ফুল, আর পরিচিত পাখিগুলো – সবই তো আছে। তবুও এমন মনে হচ্ছে কেন? সারাদিনটা তার কেমন এক বিষন্নতায় কাটলো। বিকালে বেরিয়েছে। রিওতে পৌঁছে দেখে বসে আছে তানিশা। নাহ, শুধু তানিশা না… সাথে আরেকজন। আরেকটা ছেলে। দূর থেকে দেখে মনে হলো, খুব পরিচিত চেহারা। হ্যাঁ, ওই যে… কোচিং এ যে ছেলেটা ক্লাস নিতো। রিশান বুঝে উঠতে পারছেনা। যেন হঠাত তার মাথায় আঁকাশ ভেঙ্গে পড়লো। দূর থেকে দেখে আর সামনে পা বাড়ায়নি। নীচে নেমে ফোন দেয় তানিশাকে।কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, এখনও আসতে পারলেনা না? তানিশা বলে উঠে।

আগে বলো ঐ লোকটা কে।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো। তার জন্যই তো আজকে দেখা করতে চাইলাম!

না, যা বলার এখানেই বলো।

তানিশা একটু থামলো। তারপর নিচু গলায় বললো…সজীব।

তা আমি চিনেছি। কিন্তু সে এখানে কি করছে?

ফোন কেটে দিলো তানিশা। রিশানও চলে গেলো। একটা রিকশা ভাড়া করে চললো বাসার দিকে। আরেকটা টেক্সট এসেছে, তানিশার কাছ থেকে। তানিশা লিখেছে – “We were on a break”

খোলা বাকসো

বন্ধুরা, আপনারা শুনছেন রেডিও জোনাকি এফ এম ৩৪.৯০। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো একঘন্টা। এখন ঘড়িতে ১১টা বেজে ৩০ মিনিট। সময় হয়ে গেলো আজকের মতো বিদায় নেয়ার। তবে মন খারাপের কিছু নেই। বিরতির পর আপনাদের সবার প্রিয় অনুষ্ঠান ‘খোলা বাকসো’ নিয়ে ফিরে আসবে আর.জে. কিশোর। কোত্থাও যাবেন না, আমাদের সাথেই থাকুন, আর শুনতে থাকুন মিনার রহমানের ‘কেউ কথা রাখেনি’। রেডিওতে বাজছে…

কেউ কথা রাখেনি ভালোবাসেনি

কেউ চুপি চুপি পায় কাছে আসেনি,

কেউ গোধূলি বেলায় দু’হাত বাড়িয়ে

খুব আদর মেখে আর ডাকেনি।

আর ডাকেনি…

  • কিরে কিশোর, মন খারাপ মনে হচ্ছে?
  • হ্যাঁ, আপনাকে তো বলাই হয়নি, পরশুদিন রাতে আমার এক ফ্রেন্ড গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। শুভ্র নাম তার। ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলো। যমুনার ঐ প্রান্তে হয় দুর্ঘটনাটা। আমার ঐ ফ্রেন্ডটা বসে ছিলো সামনের দিকেই। জাস্ট এক সারি পর। বি – ২ তে। ওভারটেক করতে গিয়ে গাড়ির ডান পাশটায় ধাক্কা লাগে। গাড়ি উল্টে গিয়ে পাশের দিঘিতে পড়ে যায়। পরে গাড়ির ভেতর থেকেই তার মৃত লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
  • আর বইলেন না, ড্রাইভারগুলো যে কি খেয়ে গাড়ি চালায়… সব মুর্খের দল। রাস্তার নিয়ম কানুন বুঝেনা কিছুই। আসছে গাড়ি চালাইতে। যাহোক, গান শেষের দিকে, আপনি শুরু করেন।

“…ঘর ছাড়া বাতাস হয়ে তোমায় ভাসাতে চাই

পালতোলা নৌকায় আবার হারাবো,

ঘুম ভাঙ্গা সকাল হয়ে তোমায় হাসাতে চাই

চোখজুড়ে স্বপ্নে উড়ে বেড়াব”

হ্যালো বন্ধুরা, মিনারের গানটা নিশ্চয়ই সবার ভালো লেগেছে। মিনারের গান আমার খুব পছন্দের। যাহোক, মনটা ভীষণ খারাপ। কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধু মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। স্কুল, কলেজ একসাথে পড়েছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আলাদা হয়ে যাই। সে চলে যায় রাজশাহীতে, আর আমি চট্টগ্রামে। মন চাইছিলোনা ঘর থেকে বের হতে, তাও জোর করে চলে আসলাম। ভাবলাম, ঘরে চার দেয়ালে আঁটকে রাখলে মনটা বরং আরও খারাপ হবে। তারচেয়ে রেডিওতে চলে যাই, আপনাদের মনের কথা শুনি, তাতে ভেতরটা হালকা হবে।

যাহোক, শুরু করছি আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান, খোলা বাকসো। অনেকেই আমাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে একটা চিঠি পড়বো আজ। দেখি প্রডিউসার কার চিঠিটা বেছে নিলেন…

প্রিয়তম,

জানিনা কেমন আছো। এক বুক আক্ষেপ নিয়ে লিখতে বসলাম। তোমার অনুপস্থিততে, এই বিশেষ দিনে প্রথমদিকের স্মৃতিগুলো আনমনে হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠছে বারবার। মনে আছে তোমার সে রাতের কথা? আকাশে পূর্ণিমার  চাঁদ। মোলায়েম আলোয় চারদিকে অদ্ভুত একটা মুগ্ধতা বিরাজ করছিলো। আমি চাঁদ দেখতে বেরিয়েছি হল থেকে। বের হওয়ার পথে দেখি, তুমি একা সেন্ট্রাল ফিল্ডে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছো অনেক্ষন ধরে। দূর থেকে এই অদ্ভুত কান্ড দেখে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখা, অথচ অনেককিছু জিজ্ঞেস করেছি সেদিন তোমাকে। উত্তর দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু একবারও আমার দিকে চোখ ফেরালেনা। তাতে অবাক হয়নি মোটেও। মনে মনে ভেবেছি, আমি নিশ্চয়ই চাঁদের চেয়ে সুন্দর নই… এই খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি বলেছিলে, এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি মনের সব বিষন্নতা উবে যায়, সব কালিমা সাফ হয়ে যায়।

এরপর থেকে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম পূর্ণিমার জন্য। পূর্ণিমা রাতে, দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম প্যারিস রোড ধরে, অনেক গল্প হতো। শেষে সেই সেন্ট্রাল ফিল্ডে এসে দুজনে শুধু আঁকাশের ঐ চাদটার দিকে চেয়ে থাকতাম। কোন কথা নয়, শুধু চাঁদ দেখা। আবছা ধূসর মেঘ, গা জুড়ানো মৃদু বাতাস আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা দেখতাম সারারাত।

প্রতিবার এনিভার্সারিতে তোমার কতো প্রস্তুতি, কতো তোরজোড়। সেদিক থেকে আমি একটু পিছিয়ে ছিলাম অবশ্যই। প্রতিবারই আমার জন্য কতো সারপ্রাইজ রাখতে! তুমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চলে যাও, আমি ভীষণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। সারাদিনের অফিসের খাটুনি শেষে, পাঁচটায় রউনা দিয়ে, টানা ছয় ঘন্টার জার্নি শেষে এখানে এসে পৌঁছাতে – শুধু একটা রাত প্যারিস রোডে হাঁটার জন্য, খোলা আঁকাশের নীচে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে কাটানোর জন্য। আমার কি ভীষণ আনন্দ হতো তখন। মনে হতো, পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা আমার আনন্দের কাছে যেন ম্লান হয়ে গেছে।  

কাল আমাদের এনিভার্সারি ছিলো। ফোন দিয়েছিলাম কবার, ধরোনি। শুধু একটা টেক্সট করেছিলে। মনে আছে, বারবার রূপার কথা বলতে আমাকে? সে রূপার আজ মতো নীল শাড়িতে সেজে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। ভেবেছি, সারপ্রাইজ হয়তো। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এসে একবার দেখা দিবে। কই, আসোনি তো। এই না আসাটাই কি এবারের সারপ্রাইজ তাহলে? আমি সারারাত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। আচ্ছা, অভিমান করোনি তো? অভিমান করার মতো তো কিছু করিনি আমি। বরং আমারই তো অভিমান করার কথা…

শোন শুভ্র, নীল শাড়িটা এখনও গায়ে জড়িয়ে রেখেছি। পূর্ণিমা হয়তো নেই, কিন্তু চাঁদটা ঠিকই আছে আঁকাশে। আমরা আবার প্যারিস রোডে হাটবো, আঁকাশের চাঁদ দেখবো। অপেক্ষায় থাকলাম।

ইতি, তোমার রোশনি।

কিশোরের গলা ধরে এসেছে। কথা বলতে পারছেনা। শুধু চোখ বেয়ে জল পড়ছে অনবরত।

নীল খাম

নেদারল্যান্ড বললেই চট করে আমস্টারড্যাম বা দ্যা হেইগের কথা মাথায় চলে আসে। এই গল্পটা নেদারল্যান্ডের হলেও শহর দুটির কোনটার সাথে সম্পৃক্ত নয়। নর্থ সি’র কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠা ছোট্ট শহর লেইডেন। এই শহরটাকে অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরেছে রিন নদী।

হেমিংওয়ে। ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। জন্মসূত্রে আমেরিকান, তবে থিতু হয়েছে নেদারল্যান্ডে। পড়াশুনার বিষয় পদার্থবিজ্ঞান হলেও ছোটবেলা থেকে লেখালেখির প্রতি অগাধ আগ্রহ তার। হাইস্কুলে থাকাকালীন একটানা চারবছর অ্যানুয়্যাল রাইটিং কম্পিটিশনে প্রথম হয়েছিলো সে। লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পদার্থবিজ্ঞানের মতো এমন খটমটে একটা বিষয়ে স্নাতক করার পরও লেখালেখি থেকে দূরে সরে আসেনি। ছাত্রদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ম্যায়ার’ এর প্রতি সংখ্যায় হেমিংওয়ের একটা লেখা সবসময়ই থাকতো। এই লেখালেখির সুবাধে ক্যাম্পাসে তার জনপ্রিয়তাও ছিল বেশ। যাহোক, পড়াশুনা শেষে স্থানীয় এক দৈনিকে সাব এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছে হেমিংওয়ে। সাহিত্য পাতাটা সে দেখে। বিভিন্নজন লেখা পাঠান, সেসব লেখা ঘষামাজা করা তার কাজ। অফিসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। যখন খুশি যায়, যখন খুশি আসে। অধিকাংশ সময়ই বাইরে থেকে অফিসের কাজ সারে। বাইরে মানে, তার প্রিয় উডস রেস্তোরাঁয়।

লেইডসোয়েগে একা একটা বাসায় থাকে হেমিংওয়ে। সেখান থেকে গাড়িতে করে উডসে আসতে বার মিনিটের পথ। প্রায় প্রতিদিনই একই সময়ে আসে, একই টেবিলে বসে এবং একই খাবার অর্ডার করে – ব্রুশ্যাটা, পানি এবং লাল চা। রিন নদীর তীরে এই রেস্তোরাঁটার অবস্থান। এর ছাদের উপর একটা বহুদিনের পুরোনো উইন্ডমিল আছে বলে সহজেই দূর থেকে দেখে চেনা যায়।

রয় হেমিংওয়ের পুরোনো বন্ধু। একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। তার বাবামা ভারতীয়। নেদারল্যান্ড এসেছে অন্তত দশক দুয়েক আগে, যখন তার বয়স চার কি পাঁচ। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের কিছুই তার স্মৃতিতে নেই। সে হিশেবে পুরোদস্তর ডাচ বলা চলে। এখন ফুলটাইম ফটোগ্রাফার আর পার্ট টাইম হেমিংওয়ের আড্ডার সঙ্গী। রয় যতক্ষণে হেমিংওয়ের সাথে যোগ দেয় ততক্ষণে তার অফিসের নিয়মিত কাজ শেষের দিকে। তাই বাকি সময় জমিয়ে আড্ডা দেয়া যায়। সাধারণত আড্ডার বিষয় সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি এসব। আর মাঝে মাঝে মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়াদি।

রয় সেদিন আসেনি। অফিসের কাজও দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত একটা এসাইনম্যান্ট শেষ করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কোনোভাবেই মাথা থেকে লেখাটা বের হচ্ছিলোনা। হাঁসফাঁশ করছে আর নিজের চুল টানাটানি করছে। এর মধ্যে কারা যেন তাকে দেখে সশব্দে হেঁসে দিলো। ল্যাপটপ থেকে ডানে চোখ ফিরাতেই চোখে পড়ে একজন রমণী। পাশের টেবিলে একা বসে আছে। আসলে মেয়েটা হাসেনি, হেসেছে অন্যকেউ। বেশ লম্বা-চৌড়া, চেহারা লাবণ্যময়, আর পরনে মার্জিত পোশাক। প্রথম দেখাতেই চোখ আঁটকে যাওয়ার মতো। কি যেন ভাবছে আর আনমনে কিন্ড্যালটা নাড়াচাড়া করছে। যাহোক, চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো হেমিংওয়ে।

একটু পর রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু গোছগাছ করার প্রক্রিয়া চলছে। হেমিংওয়েও বের হবে, এমন সময় হঠাত একটা মেয়ে দৌড়ে আসলে। ভুলে কিন্ড্যালটা নাকি ফেলে গেছে, সেটা নিতে এসেছে। প্রথম দেখাতেই চিনে ফেললো হেমিংওয়ে। এইতো সেই মেয়েটা। কাউন্টার থেকে কিন্ড্যালটা সংগ্রহ করার পর বের হওয়ার পথে সামনাসামনি দেখা। অনেকটা সেধে গিয়ে হাই-হ্যালো করলো হেমিংওয়ে। কিছুক্ষন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কথাও হলো। মেয়েটার বেশ আগ্রহ নিয়ে আলাপচারিতা করলো। তার নাম ক্রিস্টিন। ডাচ নাগরিক। লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক করছে। উডস সম্পর্কে জানতে পারে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় সাধারনত উডস-এ আসা হয়না। আজকে কি ভেবে এক ফাঁকে চলে এসেছে।

অনেকদিন ক্রিস্টিনের দেখা নেই। হেমিংওয়ে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। রয় যখন মন চায় আসে, আড্ডা দেয়। যখন মনে চায়না, আসেনা। এভাবে প্রায় মাস খানেক পেরিয়ে গেলো। কোন এক বিকেল বেলা। হেমিংওয়ের কাজ শেষ। রয়ের সাথে আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয় ফরাসি বিপ্লব। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উয়াদারনীতিবাদ আর নেপোলিয়ায়নের উত্থান – এসব বিষয়ে ইনটেন্স বিতর্ক-আলোচনা চলছিল দুজনের মধ্যে। হঠাত কেউ একজন হেমিংওয়ের নাম ধরে ডাক দিলো। মাথা উঁচু করে একবার তাকাতেই চিনে ফেলে – এতো ক্রিস্টিন! হেমিংওয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় – ক্রিস্টিন, এ হচ্ছে আমার বন্ধু আর আড্ডার সঙ্গী, রয়। রয়, এ হলো ক্রিস্টিন, আমার বান্ধবী। যার কথা সেদিন তোমাকে বলেছিলাম।

ক্রিস্টিন জানতে চায়, তা কি নিয়ে এতো মনোযোগ দিয়ে গল্প হচ্ছিলো শুনি…

অবশ্যই, ফরাসি বিপ্লব, হেমিংওয়ে জবাব দেয়।

ফরাসি বিপ্লব? সিরিয়াসলি? এটাও আড্ডার বিষয় হতে পারে? ক্রিস্টিন জানতে চায়।

রয় বলে উঠে, এতো অবাক হওয়ার কি আছে? প্রতিদিনই তো এই কাজটা করি। যেমন ধরো গতোকাল আলাপ করেছি রেনেসাঁস নিয়ে। তার আগের দিন বার্লিন দেয়ালের উত্থান পতন আর তারপরদিন…

থাক থাক থাক, আর বলতে হবেনা – এই বলে থামিয়ে দেয় ক্রিস্টিন।

আলোচনায় বিষয় বদলে যায়। হেমিংওয়ে আর রয় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে বেশ কিছুদিন হলো। এর মধ্যে ক্যাম্পাস অনেক বদলে গেছে। ক্রিস্টিনের উপস্থিতিতে সেদিনের আড্ডাটা বেশ জমে উঠে। স্মৃতিচারণ চলে ক্লাসের নানান গল্প আর মজার ঘটনাদি নিয়ে। এরপর থেকে যখনই সময় পায়, উডসে চলে আসে ক্রিস্টিন। এভাবে একসময় হেমিংওয়ে আর রয়ের আড্ডার গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হয়ে উঠে সে। সারাদিন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে, আর বিকালে বেলা উডসে এসে আড্ডা দেয়। এর মধ্যে আড্ডার বিষয়েও বেশ বিচিত্রতা এসেছে। সিরিয়াস বিষয়ের পাশপাশি এখন খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়েও তিনজনের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ হয়।

তবে ক্রিস্টিনের প্রভাব শুধু আলোচনার বিষয়ে পড়েছে সেটা বললে ভুল বলা হবে। তার প্রভাব পড়েছে হেমিংওয়ের মনেও। দেখতে সুন্দরী নিঃসন্দেহে। তার উপর সিয়িয়াস কিংবা তুচ্ছ বিষয়ে ক্রিস্টিনের দৃষ্টিভঙ্গি বা আলোচনার ধরণ সত্যি অনন্য। নিয়মিত গালগল্পের মাঝেমাঝে ব্যক্তিগত বিষয়াদি উঠে আসে। বাড়তে থাকে হেমিংওয়ের অনুভূতিগুলোও। নিজের ভেতর এতোকিছু ঘটছে, কাউকে তো বলতে হয়। ক্রিস্টিনের অনুপস্থিতিতে রয়ের সাথে একদিন কথাগুলো ভাগাভাগি করে হেমিংওয়ে। রয় তার কথা শুনে বেশ শকড হয়। তারও ভালো লাগে ক্রিস্টিনকে। সেও এতোদিন কাউকে বলেনি কিছু। এরমধ্যে তার বন্ধুর ভালোলাগার কথা শুনে কুলিয়ে উঠতে পারেনা। অনেকটা জোর করে মাথা থেকে বিষয়টা ঝেড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে সে। হাজার হোক, বন্ধু তো। সে চায়না এই বিষয়টা নিয়ে তাদের বন্ধুতে টান পড়ুক। বরং রয় হেমিংওয়েকে নানান সময় পরামর্শ দেয়, চেষ্টা করে বিষয়টাকে সহজভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।  

প্রতিদিন বিকেল বেলা হয়, রয় আসে, কোন কোন দিন ক্রিস্টিনও আসে, জমে উঠে আড্ডা। ক্রিস্টিন থাকলে অনেক কিছু নিয়েই আলাপ হয়। কিন্তু না থাকলে ক্রিস্টিনই হয়ে উঠে দুজনের আলোচনার বিষয়। হেমিংওয়ের এই অবস্থা দেখে রয় পরামর্শ দেয় ক্রিস্টিনকে সোজাসাপ্টা তার অনুভুতির কথা জানিয়ে দেয়ার। হেমিংওয়েও তাই ভাবছে।

এর মধ্যে গ্রীষ্ম চলে এসেছে। চারদিকে মিষ্টি রোদ। সতের ডিগ্রী সেলসিয়াস বলা যায়। ক্যালেন্ডার মতে চব্বিশ জুলাই থেকে পাঁচ সেপ্টেম্বর একটা লম্বা ছুটি পাওয়া গেলো। সবমিলিয়ে ঘুরাঘুরির উপযুক্ত সময়। তিনবন্ধু পরিকল্পনা করে ফ্রান্সের মুজা গ্রামে তারা এই গ্রীষ্মটা কাটাবে। মুজা ফ্রান্সের দক্ষিণের একটা শহর। শিপ্ল সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী পিকাসো। আর সেখানেই ক্রিস্টিনকে ভালো লাগার কথা জানাবে হেমিংওয়ে।

পরদিন বিকাল বেলা। হেমিংওয়ে তো আছেই। আছে রয় আর ক্রিস্টিনও। মুজা গ্রামের কথা শুনে ক্রিস্টিন এক পায়ে খাড়া। গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতেই পারেনা। হেমিংওয়ের ভাষায়, “এতো সুন্দর করে সাজানো, যেন পুরো গ্রামটাই একটা বিশালাকার শিল্পকর্ম। পিকাসোর ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে ধারন করে রেখেছে এই গ্রাম।” গ্রীষ্মের ছুটি আসতে বেশীদিন বাকি নেই। প্রত্যেকেই যে যার মতো কেনাকাটা সেরে নিলো। আরেকদিন বসে ঠিক করলো কোথায় কখন কি করবে সেটা। হেমিংওয়ের উৎসাহ সবার চেয়ে বেশী। তেমন কিছু কিনেনি সে। বিশেষ কিছু বলতে নিজের জন্য ক্রিস্টিনের পছন্দের নীল রঙয়ের একটা ফ্লোরাল শার্ট আর একটা কিন্ড্যাল ওয়াসিস। কিন্ড্যালটা নিজের জন্য নয়, ক্রিস্টিনের জন্য কিনেছে।    

গ্রীষ্মের ছুটি চলে এলো। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সকাল নয়টায় সবার পার্কেরেন লেইডেন-এ চলে আসার কথা। রয় আর ক্রিস্টিন ঠিক সময়ে চলে এসেছে। হেমিংওয়ে এলো সবার শেষে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাকি ব্যাকপ্যাক ছাড়াই চলে এসেছিলো ভুলে। অর্ধেকটা পথ চলে আসার পর হুশ ফিরে তার। ফের গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। 

যাহোক, দীর্ঘ ষোল ঘন্টার জার্নি। কেমন লাগছে? রয় জানতে চায়।

সুপার এক্সাইটেড! ড্রাইভিং নিয়েও সমস্যা হওয়ার কথা না। তিনজনে ভাগাভাগি করে চালিয়ে দেয়া যাবে। ক্রিস্টিন জবাব দেয়।

আমরা আমরাই তো। গল্প করতে করতে পার হয়ে যাবে। যোগ করে রয়।

ব্রাসেলস, লুক্সেমবার্গ, জেনিভা হয়ে কান। সেখান থেকে মুজা একদম কাছেই। এই পথে কখনো যাইনি। জানায়, হেমিংওয়ে।

চলো, শুরু করা যাক বলে সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো। রয় ড্রাইভিং করছে শুরুতে। হেমিংওয়ে আর ক্রিস্টিন পেছনের আসনে বসা। গাড়ি চলছে… ইতিমধ্যে বেলজিয়ামে প্রবেশ করেছে গাড়ি। শুরুতে অনেক হই হুল্লোড় দেখা গেলেও ঘন্টা দুয়েক পর উত্তেজনায় ভাটা পড়লো। ততক্ষোনে পেছনের দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছে। রয় বেচারা ড্রাইভিং সিটে। তাই ঘুমোতে পারছেনা। ওদিকে অন্য দুই বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দেখে সহ্যও হচ্ছেনা। রয়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। খালি রাস্তাতেই নব্বই মাইল বেগে চলা গাড়িতে সজোরে ব্রেক কষলো সে। প্রচন্ড ভয়ে ঘুম থেকে হুমড়ি খেয়ে উঠে পড়ে হেমিংওয়ে আর ক্রিস্টিন। আর তাদের অবস্থা দেখে হাসতে থাকে রয়। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ট্রে তে রাখা পানির বোতল ছুঁড়ে মারে রয়ের দিকে। রয়ের গায়ে লাগেনি বোতল, উল্টো মুখ খুলে পানি ছিটকে সামনে রাখা হেমিংওয়ের ব্যাগে গিয়ে পড়েছে। যাহোক, ছোটখাটো একটা ফাইট শেষে সবাই আবার চাঙ্গা হয়ে গেলো।

গাড়ি চলছে তো চলছেই… এতোক্ষনে আরও অনেকটু পথ পাড়ি দিয়েছে। মাঝপথে বুর্গ-এন-ব্রিস এর একটা রেস্তোরায় তারা দুপুরের খাবার সেরে নিলো। সুন্দর পরিবেশ। সামনের দিকটা খোলা সবুজ প্রান্তর। খাওয়াদাওয়া সেরে সেখানটায় কিছুক্ষন বসার পর আবার গাড়িতে উঠলো তারা। এবার চালকের আসনে হেমিংওয়ে। গাড়ি চালাচ্ছে আর মাঝে মাঝে এস্প্রেসোর কাপে চুমুক লাগাচ্ছে। ঘুম কাটানোর জন্য এই প্রচেষ্টা। সুইজারল্যান্ড সীমান্ত পেরিয়ে গেছে গাড়ি। জিপিএস বলছে গাড়ি তখন ট্রেফোর্ট নামের একটা জায়গায়। এর মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। তবে ভয়ের কিছু নেই। পাহাড়গুলো এতোটা উঁচু নয়। গাড়িতে ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস বাজছে। হেমিংওয়ে ভলিউমটা বাড়িয়ে দিলো। দিনের আলো থাকলো ভীষণ ভালোভাবে উপভোগ করা যেতো। এনিয়ে ক্রিস্টিনকে হা হুতাশা করতে দেখা গেলো। হেমিংওয়ে বললো, “চিন্তা করোনা, ক্রিস্টিন। ফেরার সময় যথেষ্ট আলো থাকবে। তখন গাড়ি থামিয়ে প্রান ভরে দেখতে পারবে।” কথা শুনে ক্রিস্টিন মৃদু হাসলো।

হেমিংওয়ে অনেক্ষন ধরে ড্রাইভ করছে। সে বললো, “ক্রিস্টিন, প্রস্তুত হও। সামনে একটা কফিশপ আছে। ওইখান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই আমার কাজ। সেখানে বসে কফি খেয়ে তারপর…” কথাটা শেষ করতে পারলোনা হেমিংওয়ে, বিপরীত দিক থেকে আরেকটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিলো, দুইবার উল্টে গাড়িটা একটা বড় গাছে গিয়ে আটকালো। যেন মুহূর্তেই সব তচনচ হয়ে গেছে। পেছনের সিট থেকে কোনোভাবে বের হয়ে আসলো ক্রিস্টিন আর রয়। তাদের তেমন একটা আঘাত লাগেনি। রয়ের বা চোখের উপরে দিকটায় কাচ লেগে রক্ত বের হচ্ছে। ক্রিস্টিনের দুই পায়ে খানিকটা চোট লেগেছে। ভাগ্য কিছুটা ভালো, গাড়িটা গাছে আঁটকে ছিলো। না হয়… আচ্ছা, হেমিংওয়ে কই? মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে সামনের দরজা খুলে হেমিংওয়েকে টেনে বের করে তারা দুজন। সারা মুখে রক্ত। চেহারা দেখে বুঝার অবস্থা নেই। পেটে দুটো ভাঙ্গা কাচের টুকরো ঢুকে পড়েছে। রয় বুঝতে পারছেনা কি করবে। অজানা অচেনা চারপাশ। এর মধ্যে খবর পেয়ে হাইওয়ে পুলিশ চলে আসে। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের এক হাসপাতালে।

হাসপাতালেই সে রাত পার হলো। রয় আর ক্রিস্টিন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠলো বটে, তবে ঘুমাতে পারলোনা চিন্তায়। হেমিংওয়েকে নিয়ে যাওয়া হইয়েছিলো আই.সি.ইউ-তে। পরদিন আসলো খবরটা – বাঁচানো যায়নি হেমিংওয়েকে। শুনে যেন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা হেমিংওয়ে আর নেই। কি ভেবেছে, আর কি হচ্ছে এসব?

হাসপাতাল থেকে রিলিজ করতে হলে কিছু কাগজপত্র লাগবে। ক্রিস্টিন হেমিংওয়ে’র ব্যাগ চেক করে। খুজতে গিয়ে ব্যাগে নীল খামের ভেতর একটা চিঠি খুঁজে পায়। কিন্তু চিঠি পড়ার সময় এখন নয়। যে কাগজটা খুঁজছিল সেটা নিয়ে হাসপাতালের রেসিপশনে গেলো। প্রয়োজনীয় ফরমালিটি সেরে হেমিংওয়ের লাশ নিয়ে ফিরছে ক্রিস্টিন আর রয়। তাদের চোখে মুখে অন্ধকার। কারও মুখে একটা শব্দ নেই। কতো স্মৃতি, কতো পরিকল্পনা মুহূর্তে শেষ হয়ে গেলো। মনে পড়তেই দু চোখে শুধু পানি ঝরছে শুধু।  

ক্রিস্টিনের মনে পড়ে হেমিংওয়ের ব্যাগে থাকা চিঠিটার কথা। খুঁজে নিয়ে নীল খামের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে সে। খুব যত্ন করে হেমিংওয়ের নিজ হাতে লেখা চিঠি। তাতে লেখা –

//

প্রিয় ক্রিস্টিন,

আমার দু চোখের আলো, আমার রাজ্যের সব মুগ্ধতা।

এই প্রানের বিনিময়ে হলেও আমি তোমাকে চাই।

তুমি কি আমার হবে?   

ইতি,

হেমিংওয়ে।

//

আমি যেভাবে সময় বাচাই বা কাজে লাগাই

পৃথিবীতে আমার কাছে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে সময়ের মূল্য সবচেয়ে বেশী – এই একটা লাইন পড়তে পড়তে যে মুহূর্তটা চলে গেলো সেটা আপনি চাইলেও ফিরে আসবেনা। তাই আমি চেষ্টা করি কীভাবে সময়কে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় তার একটা উপায় খুঁজে বের করার এবং প্রতিনিয়ত সেটাকে আপডেট করার। এই লেখায় আমি চেষ্টা করবো আমি যেসব উপায় অবলম্বন করি তার একটা তালিকা তৈরি করার, যেটা হয়তো আপনাদের কাজে লাগতে পারে।

এক – সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমেই আপনার যা দরকার তা হলো সত্যিকার অর্থেই সময়কে বাঁচানোর বা কাজে লাগানোর গুরুত্ব অনুধাবন করা। এই প্রচেষ্টাকে কোনোমতেই হালকা ভাবে নেয়া যাবেনা। তাই প্রথম ধাপটা হলো নিজের মধ্যে এই অনুধাবন সৃষ্টি করা।

দুই – দিনের শেষে পরের দিনের জন্য আপনার একটা টুডু লিস্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। যখন রাতে ঘুমোতে যাবেন একবার চোখ বুলিয়ে নিন, যাতে পরের দিনের বিশেষ করে সকালের কোন কাজ ছুটে না যায়। টুডু লিস্টের আরেকটা সুবিধা হলো এতে আপনি নিজের অগ্রগতিকেও মাপতে পারবেন।  

তিন – সোস্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আমাদের দিনের দীর্ঘ একটা সময়কে অজান্তে নষ্ট করে দেয়। আমরা সবাই এমনটা বুঝার পরও এসবকে ছাড়তে পারিনা। মাস দেড়েক আগেও নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনই ছিলো। তবে একটা কারণে আমি দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলতে পেরেছি। আমি জানতাম, সোশ্যাল মিডিয়ার পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্য ও সময়ের অপচয় সহ নানান কারণে টক্সিক বা বিষাক্ত। তবে আনমনে একটা ধারণা নিজের মধ্যে কাজ করতো। তা হলো, এটা ছাড়া বোধহয় দিনাতিপাত করা অসম্ভব। এর মধ্যে আমি এমন বন্ধুকে খুঁজে পাই যে গতো বছর দুয়েক ধরে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াই চলছে। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমার ধারণা বদলে গেলো। কারন আমার সে বন্ধুটাই আমার সামনে একতা জ্যান্ত উদাহরণ হয়ে উঠলো।

  • আমি দ্রুত ফোন থেকে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এপটা আনইনস্টল করে দিলাম যাতে একসেস করার একটু দুরহ হয়।      
  • সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা কমিয়ে দিলাম যাতে আগ্রহটা কমে যায়। কারন আমরা ফেসবুকে কিছু দেয়ার পর বার বার লাইক-কমেন্ট চেক করার একতা প্রবনতা তৈরি হয়। তাই পোস্ট করা কমিয়ে দিলে সেটা থেকে বাঁচা যায়।
  • শুধুমাত্র মেসেঞ্জারটা রেখে দিলাম যোগাযোগ রক্ষার জন্য। এবং একটা সময় ঠিক করে রাখলাম যে সময়টা আমি মেসেঞ্জারে দিয়ে থাকি।

এটা আমার জন্য খুব কাজে দিয়েছে। যেমন গত দেড় মাস ধরে আমি প্রতি সপ্তাহে ফেসবুক টাইমলাইন চেক করেছি এক/দুই বার। তাও একেকবার এক মিনিটের বেশী নয়। হ্যাঁ, এভাবে মেনে চলা সবার জন্য সহজ নয়। তবে আমার মনে হয় নিজেকে বেঁধে ফেলা গেলে তা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে যায়।

(বিশ্বাস করুন, এক ফেসবুক থেকে বেঁচে থাকা আমার সময়কে যেমন অনেকটুকু বাচিয়ে দিয়েছে, তেমনি মানসিকভাবে স্থিতিশীল করেছে। এখন সারাদিনে একবারও ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের কথা মাথায় আসেনা আমার)

চার – যদি আপনার এমন কোন কাজ থাকে যেটা রিপিটেটিভ, তার জন্য দিনের একটা সময় নির্ধারন করে রাখুন। সে সময়টা আসলে সবকিছু ছেড়ে ওই কাজ শুরু করে দিন। আমার জন্য লেখালেখি সেরকম একতা কাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ল্যাপটপ নিয়ে লেখা শুরু করি।

পাঁচ – গুগল ক্যালেন্ডারের সদ্যব্যবহার করা আপনার সময়ের অনেকটুকু বাঁচিয়ে দিতে পারে। যে কাজই থাকুক, প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ ক্যালেন্ডারে তার একটা রিমাইন্ডার সেট করে রাখা এবং কাজের ধরনের উপর নির্ভর করে এলার্ট দিয়ে রাখা। এতে আপনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির সময়ও পাবেন।

ছয় – অনেকেই আছেন যারা গেম-আড্ডা-সিনেমায় অনেক সময় কাটিয়ে দেন। বিনোদন সবারই প্রয়োজন। তবে তার একটা মাত্রা থাকা উচিৎ বলে মনে করি। প্রতিদিনই আপনার নিয়ম করে আড্ডা দিতে হবে বা গেম খেলতে হবে এমন কিন্তু নয়। আর হ্যাঁ, কাজের জন্য কিছুদিন হয়তো আপনি আড্ডা মিস করবেন। তবে এর বিনিময়ে আপনি এমন কিছু পাবেন যা আপনাকে অনেকটুকু এগিয়ে রাখবে।

শেষকথা – আমার দৃষ্টিতে কোন নতুন অভ্যাস তৈরির সবচেয়ে সহজ উপায় হলো শুরু করে দেয়া। আর, নতুন অভ্যাস তৈরি অবশ্যই কঠিন। তবে একবার যদি নিজেকে বেঁধে ফেলা যায়, তাহলে ক্রমেই তা সহজ সাধ্য হয়ে যাবে।

প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য শুভকামনা! ভালো থাকবেন।  

ভাবনায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা; একটি প্রস্তাবনা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নানান সময় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক বিকাশের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন শুধুমাত্র পড়াশুনায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে সন্তানদের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা বাড়াতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাটাই এমনভাবে সাজানো, যেখানে একাডেমিকের বাইরে চিন্তা করারই সুযোগ নেই। শিক্ষা নামের এই ইঁদুর-দৌড়ে এক মুহুর্ত থেমে থাকলেই যে হাজার জনের পেছনে পড়ে যেতে হবে।

সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ক্রমাগত নানান পরিবর্তন নিয়ে আসছেন। নিচ্ছেন নানান উদ্যোগ। পাঠ্যবইয়ে মূল আলোচনার পাশাপাশি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন বিষয় যেমন সংযোজন-বিয়োজন করছেন, পাশপাশি বইয়ের যে কনটেন্ট, তার মান উন্নয়নে কাজ করছেন। কিন্তু ঠিকই গোড়ার গলদটা যেনো থেকেই যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তা কার্যকরী হচ্ছেনা।   

এমন অবস্থা থেকে উত্তরনের সহজ উপায় হতে পারে সকল বোর্ড পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা। (সহ-শিক্ষা কার্যক্রম বলতে সেসব কাজকে বুঝানো হচ্ছে যা একজন ছাত্র বা ছাত্রি পড়াশুনার পাশাপাশি স্বেচ্ছায় নিজের অন্তর্নিহিত প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে হিসেবে বেছে নেয়। এই মাধ্যম হতে পারে লেখালেখি, গান, অভিনয়, সামাজিক কাজ এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের সন্তানের বাবাকে সাহায্য করার কাজটি) কার্যতই এই সহ-শিক্ষাধর্মী কাজগুলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।  

শুরুটা করা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে। শিক্ষার সর্বোচ্চস্তরে এর প্রয়োগ শুরু হলে গোটা ব্যবস্থায় একধরণের ‘রিপল ইফেক্ট’ তৈরি হবে যা ক্রমান্বয়ে শিক্ষার সকল স্তরে পৌঁছে যাবে। এখন দেখা যাক এর মূল্যায়ন কেন জরুরীঃ  

  • যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে যারা ইতিমধ্যে সহশিক্ষার সাথে যুক্ত তারা যেমন তাদের কাজের জন্য মূল্যায়িত হবেন, অন্যদিকে যারা যুক্ত নয় তারাও যুক্ত হতে উৎসাহিত হবেন।   
  • সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন জীবনদক্ষতা যেমন দলগত কাজ, যোগাযোগ, মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা কৌশলীচিন্তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যা তার ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং চাকুরিজীবনের নানান ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।  
  • কোন বাবামা’ই চাননা তাদের সন্তান সারাদিন পড়াশুনার চাপের মধ্যে থাকুক। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হলে একদিকে যেমন সন্তানেরা দম ফেলার সুযোগ পাবেন, অন্যদিকে বাবামারাও একটু স্বস্তিতে থাকবেন।
  • আমাদের তরুণদের মাঝে মাদক গ্রহণের প্রবনতা ক্রমেই বাড়ছে। যদি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্যসকল বোর্ড পরীক্ষায় আবশ্যিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে সৃজনশীল কাজে অন্তর্ভুক্তি তাদের মাদকের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেবে।

আমেরিকা তথা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের কীভাবে নির্বাচন করা হয় তা নিয়ে পড়ছিলাম। যেকোন দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটা লক্ষ্য থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অংশীজনেরা সম্মিলিতভাবে শিক্ষার সে কাঙ্ক্ষিত সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জন করতে কাজ করে। এই লক্ষ্য অর্জন করাটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৃষ্টিতে একেকটা একটা পাহাড় জয়ের মতো।

কোন দল যখন পাহাড় জয় করতে যান তখন দলের সব সদস্য শুধুমাত্র একটা বিষয়ে পারদর্শী হলে আগানো যাবেনা। যেহেতু এটা একটা কঠিন কাজ, তাই বিভিন্ন সময় বিভন্ন রকম বাঁধা আসতে পারে। একটা পর্যায়ে কোন কারণে দলের মনোবল ভেঙ্গে গেলে প্রয়োজন এমন কারও যিনি দলকে উজ্জীবিত করতে পারবেন। আবার যদি হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে দরকার এমন কেউ যিনি ফার্স্টএইডে দক্ষ।

অনুরূপ, দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অথবা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থী। যদি শুধুমাত্র জিপিএ বা ভর্তিপরিক্ষার নম্বরের মাপকাঠিতেই সবাইকে মাপার চেষ্টা করা হয় তাহলে তারা একদিকে যেমন ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন না, অন্যদিকে মেধাবীরাও যথাযত মূল্যায়িত হবেন না।

কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরিক্ষায় চলমান যে একমুখী নির্বাচন প্রক্রিয়া আছে তা থেকে সরে আসা জরুরী। প্রয়োজনে কয়েকস্তরের মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। চলমান পদ্ধতিতে জিপিএ, লিখিত ও বহুনির্বাচনী পরীক্ষার উপর শতভাগ নম্বর নির্ভর করে। তার পরিবর্তে একডেমিক ফলাফলের উপর ৬৫% নম্বর বরাদ্ধ রাখা যেতে পারে। বাকি ৩৫% বিবেচনা হতে পারে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের উপর। নানান উপায়ে এই সহশিক্ষা কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করা যায় যা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সমাদ্রিত। যেমনঃ  

  • সহ-শিক্ষার ধরনের উপর ভিত্তি করে ছাত্রছাত্রীদের অর্জিত জ্ঞানের গভীরতা বুঝার লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক ‘এনালিটিক্যাল রচনা’ লিখতে দেয়া যেতে পারে।
  • ভাইভা ও প্রায়োগিক পরীক্ষায় জোর দেয়া যেতে পারে।
  • সংশ্লিষ্ট সহশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা রাখেন এমন কারও রেকমেন্ডেশন লেটার চাওয়া যেতে পারে।  

এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সহ শিক্ষা কার্যক্রমকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারা। রচনা, রেকমেন্ডেশন লেটার বা ভাইভা’র মতো বিমূর্ত মাধ্যম ব্যবহার করে একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার জন্য যাচাইকারীর যথেষ্ট অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। তাছাড়াও সিদ্ধান্তকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার সুযোগও তৈরি হয়। তবে যথাযত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে সামগ্রিক ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে পারে তা শ্রমকে ছাড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।  

—–

ইউসুফ মুন্না, কিশোরভিত্তিক সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম Reflective Teens এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে অধ্যয়নরত আছেন।