করোনা সংকট ও প্রান্তিক অর্থনীতির হালচাল

Yusuf's Diary

করোনা সংকট ও প্রান্তিক অর্থনীতির হালচাল

করোনার ভারে নুইয়ে পড়েছে গোটা দেশ। এই প্রভাব ছড়িয়ে গেছে দেশের আনাচে কানাচে। লকডাউন ছিলো ঠিকই, তবে তার অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাস্তবিক অর্থে কখনোই তার পুরোপুরি কার্যকরী ছিলোনা। সে যাই হোক, অর্থনীতির গতি যে শ্লথ হয়েছে সেটা নিশ্চিত। সামগ্রিক অর্থনীতি কোনদিকে আগাচ্ছে সেটা নিয়ে অনেকেই গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন, পর্যালোচনা করছেন, দিচ্ছেন পরামর্শ। দেশের একদম প্রান্তিক অঞ্চলের অত্যন্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কি ক্ষতি হচ্ছে? কীভাবে মোকাবেলা করছেন এসময়? সুদূর ঢাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে সেটা দেখতে পাওয়া কঠিনই বটে। মাঠের সমস্যা গভীরভাবে বোঝার জন্য আমি বিভিন্ন পেশার ১৫ জন কি ইনফরমেন্ট এর সাথে আলাপ করি। তাদের মধ্যে আছেন কাঁচা তরকারী বিক্রেতা, চা-সিগারেটের দোকানী, হলুদ-মরিচ গুড়া করার দোকানী, কুলিং কর্নার, আম বিক্রেতা, মুদির দোকান, পান-সুপারি বিক্রেতা, মুরগি-গরুর মাংস বিক্রেতা, নৌকার মাঝি, টিভি দেখার দোকান। তাদের প্রত্যেকেই একই বাজারের বিক্রেতা। তাদের পণ্যের উপর নির্ভর করে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। সেখানকার প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে। আমার দৃষ্টিতে এটা সব প্রান্তিক অঞ্চলের লোককে প্রতিফলিত করে।        

(এক) তথ্য দাতাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছেন বিগত আড়াই মাস পূর্বের তুলনায় বর্তমান মাসিক আয় সর্বনিম্ন ৫০% থেকে ৮০% পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। পানসুপারি, চা-সিগারেটের দোকানে সবচেয়ে বেশী আয় কমেছে (৭০%)। তা থেকে বুঝা যায় সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ভোক্তাগন কম প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পরিহার করে চলার চেষ্টা করছেন।

(দুই) একদিকে আয় কমে গেছে। অন্যদিকে চাহিদা থেকে গেছে একই। তাহলে চলছেন কীভাবে? প্রায় প্রত্যেকেই একই উত্তর দিয়েছেন। লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর না থাকায় ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়নি। সেখান থেকে কিছু আয় আসছে এখনও। তার সাথে সাশ্রয় করে চলছেন। তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো ব্যবসার মূলধন থেকেও ভোগ করা শুরু করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে পরিসর ক্রমাগত হ্রাস পেতে পারে। তারপরেও অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে আত্নীয়দের কাছে ধার করছেন। শুধুমাত্র এই বিশেষ পরিস্থিতির জন্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছেন খুব কম ব্যবসায়ী।

(তিন) বর্তমানে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া যেসব ছাত্র আক্ষরিক অর্থে বাড়িতে বসে আছেন, বাস্তবিক অর্থে তারা বাড়িতে বসে নেই। যদিও আগে থেকে কিছু সন্তান (১০% এর কম) ব্যবসায় অল্প সময় দিতো, তাদের প্রত্যেকেই (প্রায় ৭০%) সরাসরি বাবাকে ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন (নিয়মিত সময় দিচ্ছেন, হিসাবনিকাশ করছেন)।

(চার) সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নতুন করে অনেক ছাত্রছাত্রী ঝড়ে পড়তে পারে। অভিভাবকদের (গ্রামীণ সব পরিবারের প্রধান নীতি নির্ধারক ও সিদ্ধান্ত প্রনেতা) প্রায় প্রত্যেকেই জানিয়েছেন তারা যেকোন মূল্যে তাদের সন্তানকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সাপেক্ষে পুনঃরায় স্কুলে পাঠাবেন। শুধুমাত্র দুইজন হাইস্কুলগামী শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন তারা তাদের সন্তানকে স্কুলে ফেরত পাঠাবেন না। অভিভাবকেরা জানেন না ভবিষ্যৎ কেমন হতে যাচ্ছে। তারা চান তাদের সন্তান ব্যবসার কাজে সহায়তা করুক। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকলকেই পুষ্টিকর বিস্কুট ও উপবৃত্তি দেয়া হলেও উচ্চ বিদ্যালয়ে সেটা হয়না (সবাই উপবৃত্তি পায়না)। অন্যদিকে আগুনে ঘি ঢেলেছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। এতো বড় ছেলে, কখন স্কুল-কলেজ শেষ করে চাকরী খুঁজবে। তার উপর আবার চাকরী পেলো কি পেলোনা। কতো অনিশ্চয়তা! বরং এখন থেকে আমাকে সাহায্য করুক। নগদে লাভ। এমন চিন্তাধারা একটা কারন হতে পারে।    

গোটা দেশের প্রায় ৮৫% লোক ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে। সংখ্যায় যেটা প্রায় ৬ কোটি। এসব ইনফরমাল সেক্টরের লোকজনই আমাদের অর্থনীতির প্রান। তাদের বাঁচাতে পারলেই বেঁচে যাবে গোটা দেশ। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা আসন্ন বাজেটের জন্য নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছেন। তারা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো জানেন এবং বুঝেন। আমার এই প্রচেষ্টার কারন মাঠের সত্যিকার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা। আশাকরি উপরোক্ত সমস্যাসমূহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিবেচিত হবে।   

Please follow and like us:
error0
fb-share-icon0
fb-share-icon20
Yusuf Munna is a Bangladeshi Social Entrepreneur, Writer and Activist. He is currently serving as the founder and CEO at Reflective Teens, an internationally recognized teen based creative platform working to expose, incite and incubate the creativity of teenagers. Yusuf frequently writes for different national English dailies including Dhaka Tribune and The Business Standard.
Back To Top